রাত তখন গভীর। ১৯৭১ সালের কোনো এক অন্ধকার রাত। পূর্বাকাশে লুকিয়ে থাকা সূর্যও যেন জানত, বাংলাদেশ নামক এক নতুন সূর্যোদয়ের জন্য লড়ছে লাখো মানুষ। কুমিল্লা সীমান্তের কাছাকাছি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ঘাঁটিতে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ গভীর চিন্তায় মগ্ন। চোখেমুখে দৃঢ়তার ছাপ, হাতের মধ্যে ধরা মানচিত্র, আর চোখে দূরদর্শী দৃষ্টি। সেই মানুষটি ছিলেন মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী—যিনি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি’ হিসেবে।
সিলেটের দয়ামীর বাজারের একটি গ্রাম। বছরটা ১৯১৮। গ্রামের মসজিদের পাশের সেই ছোট্ট বাড়িটিতে জন্ম নেন ওসমানী। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন কৌতূহলী, জিজ্ঞাসু। মা যখন গ্রামের গল্প বলতেন, তিনি মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। তবে সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘বীর প্রতাপশালী বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস’। মায়ের কণ্ঠে শোনা সিরাজউদ্দৌলার বীরত্ব বা ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগ যেন তাঁর শৈশব মনকে প্রভাবিত করেছিল।
একবার এক সহপাঠী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল,
— ওসমানী, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?
— আমি এমন একজন হতে চাই, যাকে দেখে মানুষ ভয় না পেয়ে সম্মান করবে।
শৈশবের সেই স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল সিলেটের এমসি কলেজে। মেধা আর শৃঙ্খলার জন্য শিক্ষকরা তাঁকে আলাদা চোখে দেখতেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করেন ইতিহাসে, কিন্তু মন পড়ে থাকত দেশের পরিস্থিতি নিয়ে।
১৯৩৯ সাল। ইউরোপে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। ভারতবর্ষ তখনও ব্রিটিশদের অধীনে। আতাউল গনি ওসমানী যোগ দিলেন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। প্রশিক্ষণ শেষে পাঠানো হলো বর্মা (বর্তমান মিয়ানমার) ফ্রন্টে।
বর্মার জঙ্গলে টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এক অভিযানে ওসমানী নেতৃত্ব দিলেন মাত্র কয়েক ডজন সৈন্যকে। জাপানিদের শক্তিশালী বাহিনীকে কৌশলে পরাস্ত করে শত্রুবাহিনীর ঘাঁটি ধ্বংস করেছিলেন। সেই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সবার কাছে।
সেনাবাহিনীতে তখনই তাঁকে ‘দ্য বেঙ্গল টাইগার’ নামে ডাকতে শুরু করে সহযোদ্ধারা। কারণ তাঁর বাঙালি পরিচয় ও অদম্য নেতৃত্ব।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমননীতি যখন তীব্র হয়, তখন ওসমানী অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার রাস্তায় যখন রক্তের বন্যা বয়ে যায়, তখন এই অবসরপ্রাপ্ত সেনানায়ক আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি।
২৬ মার্চের সকালে তিনি কোলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে ১১টি সেক্টরে দেশকে ভাগ করে কৌশলগত যুদ্ধ পরিচালনা হয়।তিনি গেরিলা যুদ্ধের কৌশল চালু করেন যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে দিশেহারা করে তোলে। ‘অপারেশন জ্যাকপট’ পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি জাহাজ ডুবিয়ে দেন, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে।
এক রাতে সেক্টর কমান্ডাররা ওসমানীকে খবর পাঠালেন,
— স্যার, পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লা সীমান্তে শক্ত ঘাঁটি গড়েছে। এখন কী করবো?
ওসমানী তখন কোলকাতায় মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে ছিলেন। টেবিলের ওপর মানচিত্র ছড়ানো। টর্চের আলোয় তিনি মানচিত্রে চোখ বুলিয়ে বললেন,
— আক্রমণ করো, তবে সোজা ফ্রন্ট থেকে নয়। চারপাশ ঘিরে ভেতরে ঢুকে টার্গেট করো অস্ত্রের ডিপো।
মুক্তিযোদ্ধারা সেই কৌশল প্রয়োগ করে বিশাল এক পাকিস্তানি ঘাঁটি ধ্বংস করে দেন।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ওসমানীর পরিকল্পনায় পরিচালিত হয় ‘অপারেশন জ্যাকপট’। মুক্তিযোদ্ধারা চারটি বন্দরে (চট্টগ্রাম, মোংলা, নারায়ণগঞ্জ,চাঁদপুর) একযোগে পাকিস্তানি জাহাজ ডুবিয়ে দেন। এই অপারেশন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ভীত হয়ে পড়ে।
সেদিন রাতে এক মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল,
— স্যার, আমরা জিতে গিয়েছি। কেমন লাগছে?”
ওসমানী বলেছিলেন,
— আমরা স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু দায়িত্ব শেষ হয়নি। আমাদের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখতে হবে সবসময়।
যুদ্ধের পর ওসমানী রাজনীতিতে আসেন। জাতীয় আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর সাথে যুক্ত হন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু যখনই দেখেছেন দেশের স্বার্থে কিছু ক্ষতিকারক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, প্রতিবাদ করেছেন।
১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ওসমানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সিলেটের মাটিতে শায়িত হন এই বীর।
মেজর জেনারেল এম এ জি ওসমানী কেবল একজন সেনানায়ক ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক আদর্শ, এক অনুপ্রেরণা।
‘যে জাতি সাহসের সাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সেই জাতি কখনো পরাজিত হয় না।’
ওসমানী ছিলেন সেই সাহসের প্রতিমূর্তি, যার প্রজ্ঞা, নেতৃত্ব ও দেশপ্রেমের গল্প আজও ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে।
[1:04 am, 17/02/2025] Imran Bhai BMB: ঢাকায় প্রথম বইমেলা: ১৯৫৪ সালের এক ঐতিহাসিক আয়োজন
আজকের অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব। কিন্তু এর শেকড় খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৫৪ সালে, যখন ঢাকায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয়েছিল একটি ছোট পরিসরের বইমেলা। এটি শুধু একটি বই বিক্রির আয়োজনই ছিল না; বরং ছিল ভাষা ও সাহিত্য আন্দোলনের চেতনাকে জাগ্রত করার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের দুই বছর পর, ১৯৫৪ সালে ঢাকার বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে (বর্তমানে বাংলা একাডেমি চত্বর) আয়োজিত হয় প্রথম বইমেলা। ভাষা আন্দোলনের আবেগ তখনও তাজা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ ছিল প্রবল। সেই সময় ঢাকার শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও প্রকাশকরা একত্রিত হয়ে আয়োজন করেন এ মেলা, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা বইয়ের প্রচার-প্রসার বাড়ানো এবং পাঠকদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করা।
এই বইমেলার আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন সাহিত্যিকরা। সাহিত্যিক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জ্ঞানতাপস ড. এনামুল হকসহ অনেক বুদ্ধিজীবী এবং প্রকাশকরা এতে যুক্ত ছিলেন। প্রথমবারের মতো এমন উদ্যোগে লেখকদের বই প্রকাশ ও পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
প্রথম বইমেলায় অংশ নিয়েছিল মাত্র ২০-২৫টি প্রকাশনী, যার মধ্যে ছিল মওলানা আকরম খানের ইসলামিয়া লাইব্রেরি, এমদাদিয়া লাইব্রেরি, বিদ্যার্থী প্রকাশনী ও আহমদ পাবলিশিং হাউস। বইয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০, যা প্রধানত বাংলা ভাষা, ইতিহাস ও সাহিত্য সম্পর্কিত। শিক্ষার্থী, সাহিত্যিক ও সাধারণ পাঠকেরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে মেলায় অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে নতুন প্রজন্মের হাতে বাংলা বই তুলে দেওয়ার এ উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বই বিক্রির পাশাপাশি ছিল সাহিত্য আলোচনা, কবিতা পাঠের আসর, এবং বই প্রকাশের পরিকল্পনা।
১৯৫৪ সালের এই ছোট বইমেলাই পরবর্তী সময়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র পথ সুগম করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা তৈরি হয় এখান থেকেই। এরপর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলা একাডেমি একে নিয়মিত আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। অবশেষে ১৯৮৪ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এর আনুষ্ঠানিক রূপ দেয় বাংলা একাডেমি।
প্রথম বইমেলার সফল আয়োজনই আজকের বিশাল ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। আজ এটি কেবল একটি বইমেলা নয়; এটি এক মাসব্যাপী বাঙালি সংস্কৃতির মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। দেশি-বিদেশি লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে এই আয়োজন। ১৯৫৪ সালের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা যদি না থাকত, তাহলে হয়তো এত বিশাল পরিসরে বাংলা ভাষার এই সেরা উৎসব গড়ে উঠত না।
১৯৫৪ সালের ঢাকার প্রথম বইমেলা ছিল একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ, যা পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিক ও পাঠকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্থাপন করে। এটি শুধুমাত্র বই বিক্রির আয়োজন ছিল না; বরং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার এবং সংরক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আজকের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র সাফল্যের মূলে রয়েছে সেই প্রথম বইমেলার অগ্রণী ভূমিকা, যা বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
Leave a comment