Home আন্তর্জাতিক সফট পাওয়ারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কোথায়?
আন্তর্জাতিক

সফট পাওয়ারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কোথায়?

Share
Share

বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার সংজ্ঞা শুধু বলপ্রয়োগ বা অর্থনৈতিক প্রভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—আকর্ষণ, গ্রহণযোগ্যতা ও নৈতিক অবস্থান থেকেও একটি রাষ্ট্র অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে। এটাই সফট পাওয়ার, যার ধারণা প্রবলভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে, এই সফট পাওয়ারের গুরুত্ব বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি সফট পাওয়ারের মূল্য অস্বীকার করে তার শাসনামলে এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের বহুপক্ষীয় সম্পর্ক ও নৈতিক নেতৃত্বকে দুর্বল করে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে যাওয়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে আসা, ইউএসএআইডি ও ভয়েস অব আমেরিকার মতো নরম শক্তির প্রধান মাধ্যমগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করা কিংবা মিত্রদেশগুলোর ওপর অহেতুক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি আমেরিকার বহির্বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে আনেন।

ক্ষমতা মানে কারও ওপর ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং এমনভাবে প্রভাবিত করা যাতে অন্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুসরণ করে। শীতল যুদ্ধের সময়, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পূর্ব ইউরোপে সেনাবাহিনী পাঠাতে হয়েছিল প্রভাব বজায় রাখতে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত ন্যাটোতে দেশগুলো স্বেচ্ছায় যুক্ত হয়। এই পার্থক্যই বোঝায় সফট পাওয়ারের প্রকৃত শক্তি—নিয়ন্ত্রণ নয়, সম্মতি।

জোসেফ এস নাই-এর মতে, রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই হার্ড পাওয়ারের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হন কারণ সেটি তাৎক্ষণিক ফল দেয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে সেটি ব্যয়বহুল এবং টেকসই নয়। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, বার্লিন প্রাচীর ধ্বংস হয়েছিল মানুষের চেতনার পরিবর্তনে, কামানের গোলায় নয়। পশ্চিমা মূল্যবোধের প্রতি আকর্ষণই সোভিয়েত ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক ‘উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ গড়ে তোলে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেই কাঠামোগুলো থেকে ধীরে ধীরে সরে আসে। এর ফলে শুধু আমেরিকার অবস্থানই দুর্বল হয়নি, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর আস্থাও বিশ্বজুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি তার দেশের নরম শক্তির ভিত্তিগুলোকে অস্বীকার করেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কেও অবিশ্বাস গড়ে ওঠে। ডেনমার্ক, কানাডার মতো গণতান্ত্রিক মিত্রদেরও নিরাপত্তাহীনতা ও অনাস্থা তৈরি হয়। অথচ এই সম্পর্কগুলোই ছিল চীনের মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের বড় সম্বল।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সাংবিধানিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো দেশটিকে একেবারে ভেঙে পড়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ট্রাম্পের মতো নেতা চার বছর ক্ষমতায় থাকলেও, গণতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে হয়নি পুরোপুরি। তবে তা চিরকাল বজায় থাকবে—এই আত্মতুষ্টি বিপজ্জনক।

বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবশালী হিসেবেই টিকে থাকতে হলে সফট পাওয়ারের গুরুত্ব আবারও উপলব্ধি করতে হবে। এটি শুধুই ‘মধুর ভাষণ’ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত মূলধন, যা হার্ড পাওয়ারের ব্যয় ও সংঘাত এড়িয়ে বিশ্বব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেওয়ার একমাত্র কার্যকর উপায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিগুলো যদি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা হয়ে দাঁড়ায়, তবে যুক্তরাষ্ট্র শুধু তার মিত্রদের আস্থা হারাবে না, বরং নিজের অবস্থানও হারাবে বিশ্বের চোখে।

— জোসেফ এস নাই, সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের সহকারী সচিব

 

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

জিসানের ব্যাটিং ও রাকিবুলের বোলিংয়ে নেপালকে হারাল বাংলাদেশ ‘এ’

ডারউইনে টপ এন্ড টি–টোয়েন্টি সিরিজে প্রথম জয় পেয়েছে বাংলাদেশ ‘এ’ দল। পাকিস্তান শাহিনসের বিপক্ষে হার দিয়ে আসর শুরু করলেও আজ শনিবার নিজেদের দ্বিতীয়...

নতুন সংবিধানের দাবি এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্রে ‘সংস্কারকৃত সংবিধান’ শব্দ ব্যবহার করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবিকে পাশ কাটিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয়...

Related Articles

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ৬২ হাজারে পৌঁছাল

ইসরায়েলের চলমান হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৬২ হাজারে...

নিউইয়র্কে রেস্তোরাঁয় বন্দুক হামলায় নিহত ৩

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনে আবারও ভয়াবহ বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় সময়...

ই’সরায়েলজুড়ে বিক্ষোভ, গা’জায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে অচল জেরুজালেম-তেল আবিব

গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে রবিবার ইসরায়েলজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।...

নতুন এডিনবরার নর্দান আসনে স্কটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে লেবার প্রার্থী ফয়ছল চৌধুরী

নবগঠিত এডিনবরার নর্দান আসনের জন্য আসন্ন স্কটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী...