দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) অনুষ্ঠিত হলো কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ—রাকসু (Rajshahi University Central Students’ Union) নির্বাচন। শুক্রবার দিনব্যাপী ভোটগ্রহণ শেষে প্রকাশিত ফলে সহসভাপতি (ভিপি) ও সহকারী সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীদের জয় হয়েছে, আর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জয় পেয়েছেন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে ফিরে এলো বহুল প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক চর্চার আবহ।
প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, ভিপি (সহসভাপতি) পদে শিবির সমর্থিত সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ পেয়েছেন ১২,৬৮৭ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত শেখ নূর উদ্দীন আবির পেয়েছেন ৩,৩৯৭ ভোট। ফলে ব্যবধান দাঁড়ায় ৯,২৯০ ভোটে, যা রাকসু ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ ব্যবধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার পেয়েছেন ১১,৫৩৭ ভোট, যা তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির সমর্থিত ফজলে রাব্বি ফাহিম রেজার ৫,৭২৯ ভোট থেকে ৫,৮০৮ ভোটের ব্যবধানে বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় প্রভাবের বাইরে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর এমন জয় বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে এক ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি (এজিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তুলনামূলকভাবে ঘনিষ্ঠ। সেখানে শিবির সমর্থিত প্রার্থী সালমান সাব্বির পেয়েছেন ৬,৯৭১ ভোট, আর ছাত্রদল সমর্থিত জাহিন বিশ্বাস এষা পেয়েছেন ৫,৯৪১ ভোট। ব্যবধান মাত্র ১,০৩০ ভোট হলেও ফলাফল শিবিরের পক্ষে গিয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি ভবনের ১৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। মোট ২৮,৯০১ জন ভোটারের মধ্যে ৬৯.৮৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। নারী ভোটার ছিলেন ১১,৩০৫ জন ও পুরুষ ভোটার ১৭,৫৯৬ জন। ছয়টি নারী হলে ভোট পড়ার হার ৬৩.২৪ শতাংশ।
রাত সাড়ে ৮টা থেকে ভোট গণনা শুরু হয় এবং রাত সাড়ে ১০টার দিকে নারী হলের ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে গণনা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। নির্বাচনে ২৩টি কেন্দ্রীয় পদে ২৪৭ জন প্রার্থী, হল সংসদের ১৫টি পদে ৫৯৭ জন প্রার্থী এবং সিনেট প্রতিনিধি পদের ৫টি পদে ৫৮ জন প্রার্থী অংশ নেন। রাকসুর ভিপি পদে ১৮ জন, জিএস পদে ১৩ জন, এবং এজিএস পদে ১৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ভোট গণনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাত ১১টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করে। ক্যাম্পাসজুড়ে তৎক্ষণাৎ শুরু হয় উল্লাস।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন পর ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা এই নির্বাচনকে “গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের সূচনা” হিসেবে আখ্যা দেন।
ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থী বলেন,“আমরা শুধু ভোট দিয়েছি তা নয়, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের চর্চা ফেরানোর সাক্ষী হয়েছি।” রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় ৩০ বছর আগে, ১৯৯৪ সালে। এরপর দীর্ঘ বিরতি শেষে এবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনকে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুনর্জাগরণ হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সেতুবন্ধন তৈরি এবং নেতৃত্ব বিকাশের ধারাবাহিকতা রক্ষায় এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। রাকসু নির্বাচন ২০২৫ শুধু একটি ভোট প্রক্রিয়া নয়—এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত গণতান্ত্রিক চর্চার প্রত্যাবর্তন। ভিপি ও এজিএস পদে শিবিরের জয় এবং জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সাফল্য প্রমাণ করেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে মতের ভিন্নতা থাকলেও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নির্বাচন তাই ভবিষ্যতের শিক্ষার্থী নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য এক অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
Leave a comment