আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দল ভাঙা ও দল ছাড়ার যে স্রোত দেখা যাচ্ছে, তা সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অতীতের মতো এবারও একাধিক রাজনৈতিক দল জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। তবে জোটবদ্ধ রাজনীতির এই পর্যায়ে ছোট ও তুলনামূলক কম পরিচিত দলগুলোর নেতাদের মধ্যে যে হারে বড় দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা আগে কখনো দেখা যায়নি। এর মূল কারণ হিসেবে সামনে আসছে একটি বিষয়—নির্বাচনী প্রতীক বা ‘মার্কা’।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিচিতি পাওয়া তরুণ নেতৃত্বের অন্যতম মুখ রাশেদ খান শনিবার গণঅধিকার পরিষদ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। যোগ দেওয়ার পরপরই তিনি ঝিনাইদহ-৪ আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন পান। এই ঘটনাকে অনেকেই বর্তমান নির্বাচনী বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখছেন।
এর আগে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)–র মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদও নিজ দল ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন, উদ্দেশ্য—ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা। শুধু পদত্যাগ নয়, ধানের শীষে ভোট করার সুযোগ পেতে দল বিলুপ্ত করার নজিরও ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত। আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো শরিক দলের প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ পেত। কিন্তু গত নভেম্বরে আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন সেই সুযোগ বন্ধ করে দেয়। নতুন বিধান অনুযায়ী, নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল জোট করলেও নির্বাচনে অংশ নিতে হবে নিজ দলের প্রতীকেই।
বিএনপিসহ কয়েকটি সমমনা দল এই সংশোধনের বিরোধিতা করে আইন পরিবর্তনের অনুরোধ জানালেও তা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি উচ্চ আদালতে রিট করেও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো ইতিবাচক রায় পাওয়া যায়নি। ফলে বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ছোট দলগুলোর সামনে দুটি পথই খোলা থাকছে—নিজ দল বিলুপ্ত করা অথবা দল ছেড়ে বড় দলে যোগ দেওয়া।
রাশেদ খান বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে প্রতীক একটি বড় ফ্যাক্টর। তার মতে, বিএনপি
অধ্যুষিত এলাকায় ধানের শীষ ছাড়া জেতা কঠিন। একই কথা বলছেন বিএনপির শরিক জোটের একাধিক নেতা। তাদের বক্তব্য, নিজ দলের প্রতীকে ভোট করলে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন। এবারের নির্বাচনে সংসদের নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ফলে বড় দলের প্রতীকে ভোট না পেলে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাচ্ছে। রাজনৈতিক মহলে এটিকে দল ছাড়ার পেছনে বড় কৌশলগত কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই বাস্তবতার ফলেই এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, বিএলডিপির একাংশের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাসহ একাধিক নেতা নিজ দল বিলুপ্ত করে বা দল ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। ববি হাজ্জাজের ভাষায়, আগে আরপিও অনুযায়ী জোটের প্রতীকে নির্বাচন করা যেত, কিন্তু এখন ‘মার্কার যথাযথ ব্যবহার’ করতেই অনেককে এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
তবে সবাই যে এই স্রোতে গা ভাসাচ্ছেন, এমন নয়। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বিএনপি জোটের সমর্থন নিয়েও নিজ দলের ‘ট্রাক’ প্রতীকেই নির্বাচন করছেন। আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)–ও আপাতত নিজস্ব প্রতীক ‘গরুর গাড়ি’ নিয়ে নির্বাচনে থাকার কথা জানাচ্ছে, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো বাকি।
গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি বাম ও প্রগতিশীল দলও নিজ নিজ প্রতীকেই নির্বাচনে অনড় অবস্থান নিয়েছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তাদের ‘কোদাল’ প্রতীক পরিচিত এবং তারা সেটিতেই ভোট করবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতা বাংলাদেশের ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গভীর সংকেত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন মনে করেন, বড় দলের ছায়ায় ঢুকে পড়লে ছোট দলগুলো কেবল সাংগঠনিকভাবেই নয়, আদর্শিকভাবেও হারিয়ে যায়। তার ভাষায়, “এখন দল করা মানেই সংসদে জয়লাভ—এই লক্ষ্যটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে।”
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বহুদলীয় রাজনীতির বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ছোট দলগুলো হয় বড় দলে বিলীন হবে, না হয় রাজনৈতিক মানচিত্র থেকেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।
সব মিলিয়ে, ধানের শীষসহ বড় দলের প্রতীকের প্রতি এই নির্ভরতা বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে—এই মার্কা-কেন্দ্রিক রাজনীতি কি দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে, নাকি রাজনৈতিক বহুত্বকে আরও সংকুচিত করবে? এর উত্তর দেবে সময় এবং ভোটের রায়।
Leave a comment