বড়দিনকে কেন্দ্র করে ভারতে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক হামলা, গির্জা ভাঙচুর এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ছুটি বাতিলের ঘটনায় দেশজুড়ে উদ্বেগ ও ক্ষোভ বাড়ছে। বিভিন্ন রাজ্যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর আক্রমণের মুখে খ্রিষ্টানরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। একই সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে বড়দিনের ছুটি বাতিল বা বাধ্যতামূলক কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে অনেকেই দেখছেন প্রতীকী বর্জন এবং সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।
কেরালায় লোক ভবনের কর্মীদের জন্য ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের ছুটি বাতিল করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘সুশাসন দিবস’ কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতির রাজ্য হিসেবে পরিচিত কেরালায় এ সিদ্ধান্ত ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা বলছেন, বড়দিন কেবল একটি ছুটির দিন নয়; এটি তাঁদের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় উৎসব। সেখানে বাধ্যতামূলক সরকারি কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়াকে নিরপেক্ষতা নয়, বরং সংখ্যাগুরু আদর্শের আধিপত্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।
একই ধারা দেখা যাচ্ছে উত্তর প্রদেশেও। সেখানে যোগী আদিত্যনাথ সরকার ঘোষণা দিয়েছে, বড়দিনে স্কুল বন্ধ থাকবে না এবং শিক্ষার্থীদের সরকারি কর্মসূচিতে অংশ নিতে হবে। খ্রিষ্টান সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এসব সিদ্ধান্ত ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে প্রান্তিক করে তুলছে।
প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সহিংসতার চিত্র আরও ভয়াবহ। ‘ইভানজেলিক্যাল ফেলোশিপ অব ইন্ডিয়া’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ছিল ৬০১টি, যা ২০২৪ সালে বেড়ে অন্তত ৮৩০টিতে পৌঁছেছে—গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব ঘটনায় শারীরিক হামলা, প্রার্থনায় বাধা, গির্জা ভাঙচুর, সামাজিক বর্জন এবং ‘জোরপূর্বক ধর্মান্তর’-এর অভিযোগ তুলে যাজক ও সন্ন্যাসিনীদের হেনস্তার মতো ঘটনা রয়েছে।
সহিংসতার মানচিত্রে সবচেয়ে বেশি ঘটনার খবর এসেছে উত্তর প্রদেশ থেকে। এরপর রয়েছে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা। ছত্তিশগড়ের ধামতরি জেলায় জুন মাসে রোববারের প্রার্থনার সময় একটি গির্জায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও বাইবেল পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে ভবিষ্যতে প্রার্থনা না করার হুমকি দেয়। এ ঘটনার পর অনেক খ্রিষ্টান ভয়ে সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
মধ্যপ্রদেশের জাবালপুরে থানার ভেতরেই জ্যেষ্ঠ যাজকদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে। তাঁরা আটক খ্রিষ্টান পুণ্যার্থীদের পক্ষে কথা বলতে গিয়েছিলেন। যদিও একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, তাত্ক্ষণিক গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি। এসব ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে কার্যকর ‘ধর্মান্তরবিরোধী আইন’ এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। সাধারণ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকেও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলোর মতে, আইনের প্রয়োগের চেয়েও এসব আইন ব্যবহার করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাতে জনপরিসরে খ্রিষ্টানদের উপস্থিতি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এমন ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠছে। বড়দিনের ছুটি বাতিল, গির্জা ভাঙচুর বা যাজকদের ওপর হামলার খবর আর সাংবিধানিক সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে না। অথচ ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমান নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা দেয়। বাস্তবে সেই অধিকার কতটা কার্যকর, তা নিয়ে ক্রমেই প্রশ্ন বাড়ছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, কেরালার বড়দিনের ছুটি বাতিলের ঘটনা নিছক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি একটি বৃহত্তর আদর্শিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। যেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনপরিসরকে ধীরে ধীরে সংখ্যাগুরুবাদী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পুনর্গঠন করা হচ্ছে। এর ফলে সংখ্যালঘুদের প্রতীকী ও বাস্তব জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে।
বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদের দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর এই ধারাবাহিক হামলা ও বর্জন দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতির ওপর গুরুতর ছায়া ফেলছে। প্রশ্ন উঠছে, রাষ্ট্র ও সরকারের নীরবতা কি এই সহিংসতা ও বর্জনের প্রতি পরোক্ষ সম্মতির বার্তাই দিচ্ছে।
সূত্র: দ্য ওয়্যার

Leave a comment