ভারতের রাজস্থানের যোধপুরে ঘটে গেছে এক হৃদয়বিদারক ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা, যা আবারও গ্রামাঞ্চলে বিদ্যমান কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস এবং অশিক্ষার ভয়াবহ প্রভাব প্রকাশ করেছে।
বিয়ের জন্য ‘নরবলি’ দিলে ভাগ্য পরিবর্তন হবে—এমন অযৌক্তিক ধারণায় বিশ্বাস করে চার নারী মিলে মাত্র ১৭ দিনের একটি নবজাতককে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিহত শিশুটি তাদেরই ভাগ্নে। স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওর মাধ্যমে এই নির্মম ঘটনাটি সামনে আসে। ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী শিশুটিকে কোলে নিয়ে কিছু মন্ত্রোচ্চারণ করছেন এবং আশপাশে থাকা অন্য নারীরাও সেই মন্ত্র পাঠে অংশ নিচ্ছেন।
তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা, তারা লোক দেবতা ভৈরবের উদ্দেশে এই মন্ত্র পাঠ করছিলেন—যা বহু এলাকায় কিছুগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত রিচুয়াল বা ধর্মীয় আহ্বানের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। শিশুটির বাবা জানান, যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত, তারা তার শ্যালিকা—অর্থাৎ শিশুটির চার খালা। বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের কারও বিয়ে হয়নি। পরিবার-পরিজনের ওপর ভর করে থাকা এই বৈবাহিক অস্থিরতা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এ অবস্থায় গ্রামের কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকের পরামর্শে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, নরবলি দিলে দেবতার কৃপায় তাদের বিয়ের যোগ মিলবে।
বাবার ভাষ্য অনুযায়ী, শিশুটি জন্মানোর পর থেকেই চার খালা বিভিন্ন ধরনের লৌকিক আচার পালন করছিলেন। তবে কোনোভাবেই তিনি বা শিশুটির মা জানতেন না যে তারা এভাবে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেন।
তিনি বলেন,“তারা মনে করেছিল আমার ছেলেকে বলি দিলে তাদের শিগগিরই বিয়ে হবে। এটি তাদের অন্ধবিশ্বাসের ফল, আর তার শিকার হলো আমার শিশুটি।” তদন্তকারীরা জানান, মন্ত্রপাঠ চলাকালীন এক পর্যায়ে তারা শিশুটিকে মাটিতে শুইয়ে পা দিয়ে চাপ দিয়ে হত্যা করে। পরে তারা এটিকে ‘দেবতার উদ্দেশ্যে বলি’ বলে দাবি করে। ঘটনাটি ঘটার পরপরই সন্দেহের বশে পরিবার পুলিশে খবর দেয় এবং তদন্ত শুরু হয়।
যোধপুর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, ঘটনাটি নিছক পারিবারিক বিরোধ নয়, বরং এটি স্পষ্টতই একটি রিচুয়ালিস্টিক মার্ডার। স্থানীয় কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে সচেতনতা ও শিক্ষার ঘাটতিতে এমন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। পুলিশ ইতোমধ্যে শিশু হত্যার অভিযোগে চার নারীকেই গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ষড়যন্ত্র এবং কুসংস্কারমূলক অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। আদালতে উপস্থাপনের আগে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কাদের প্ররোচনায় তারা এমন কাজে লিপ্ত হয়েছে, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঘটনার ভিডিওটি স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে এবং অনেকেই প্রশ্ন তোলেন—২১ শতকের ভারতে কুসংস্কারের ভয়াবহ অস্তিত্ব এখনও কীভাবে বজায় থাকে? বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণে এমন নির্মম ঘটনার পুনরাবৃত্তি সমাজকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
নিহত শিশুটির বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, “আমি আমার সন্তানের জন্য বিচার চাই। যারা তাকে হত্যা করেছে, তারা আমার স্ত্রী-র নিজের বোন হলেও তাদের ক্ষমা করার কোনো সুযোগ নেই।”রাজস্থানের এই ঘটনাটি শুধু একটি পরিবারকে নয়, গোটা সমাজকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এটি দেখিয়ে দিয়েছে অন্ধবিশ্বাস কতটা ঘাতক হতে পারে এবং সমাজে সচেতনতা, মানবিক শিক্ষা ও আইনি কঠোরতার প্রয়োজন কতটা জরুরি।
Leave a comment