বাংলাদেশে নানা সময়ে বিভিন্ন বই নিষিদ্ধ বা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কখনো ইতিহাস বিকৃতি, কখনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আবার কখনো রাজনৈতিক বিতর্ক কিংবা অশ্লীলতার অভিযোগে এসব বইয়ের প্রকাশনা, বিতরণ ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিছু বই নিষিদ্ধ হওয়ার পর মামলার মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারও করা হয়েছে।
সরকারি পর্যায়ে এ সংক্রান্ত কোনো নির্দিষ্ট তথ্যভাণ্ডার নেই, তবে প্রকাশনা খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বইয়ের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তবে যে কয়েকটি বই নিষিদ্ধ হয়েছে, সেগুলো একেক সময় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
নারী (হুমায়ুন আজাদ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘নারী’ (১৯৯২) বইটি নারীবাদ নিয়ে লেখা অন্যতম আলোচিত নন-ফিকশন বই। বইটি প্রকাশের পর পরই ইসলামবিরোধী ও অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বইটি বাজেয়াপ্ত করার আবেদন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর বিএনপি সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
তবে, আদালতে আইনি লড়াইয়ের পর ২০০০ সালের ৭ মার্চ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় এবং আদালত বইটিকে অশ্লীল নয় বলে রায় দেন। বর্তমানে বইটি বাজারে পাওয়া যায়।
হুমায়ুন আজাদের অন্যান্য বই, বিশেষ করে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর তীব্র প্রতিক্রিয়া ও বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছিল। ২০০৪ সালে বইমেলা থেকে ফেরার পথে একদল সন্ত্রাসী তাঁকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে, যা পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়।
লজ্জা (তসলিমা নাসরিন)
নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিনের লেখা ‘লজ্জা’ (১৯৯৩) উপন্যাসটি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে রচিত হয়েছিল। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ সরকার ১১ জুলাই ১৯৯৩ তারিখে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
সরকারি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বইটি “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে”। নিষিদ্ধ হওয়ার আগেই বইটির ৫০ হাজারের বেশি কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
লজ্জা নিষিদ্ধ হওয়ার পর তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থী দলগুলো বিক্ষোভ করে এবং তাঁকে ফাঁসির দাবি তোলে। একপর্যায়ে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এই বইটি পরবর্তীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানেও নিষিদ্ধ হয়।
‘ক’ (তসলিমা নাসরিন)
২০০৩ সালে প্রকাশিত তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘ক’ প্রকাশের পরপরই বিতর্কের জন্ম দেয়। বইটিতে তিনি নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং কিছু বিশিষ্ট লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের নাম প্রকাশ করেন।
এটি প্রকাশের পর কয়েকজন ব্যক্তি মানহানির মামলা দায়ের করেন, যার ফলে আদালত বইটির বিক্রি ও প্রচার নিষিদ্ধ করে। পরে ২০১৫ সালে আদালত মামলাটি খারিজ করে দিলেও বাংলাদেশে বইটি আর পুনঃপ্রকাশিত হয়নি।
আমার ফাঁসি চাই (মতিয়ুর রহমান রেনটু)
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত মতিয়ুর রহমান রেনটুর ‘আমার ফাঁসি চাই’ বইটি রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়। বইটিতে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তোলা হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে।
রেভোলিউশন, মিলিটারি পারসোনেল অ্যান্ড দ্য ওয়ার অব লিবারেশন ইন বাংলাদেশ (কর্নেল অলি আহমেদ)
২০০৮ সালে প্রকাশিত কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের বইটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে ২০২০ সালে আদালতের নির্দেশে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
বাংলাদেশে বই নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া
বাংলাদেশে বই নিষিদ্ধ করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বই সংক্রান্ত বিতর্ক উঠলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং বাংলা একাডেমি এর ভূমিকা পালন করে।
এছাড়া, একুশে বইমেলার সময় একটি বিশেষ টাস্কফোর্স কাজ করে, যারা বিতর্কিত বই সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে এটি শুধুমাত্র বইমেলা কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের মতো বিশ্বেও অনেক দেশে বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ:
• উত্তর কোরিয়া এবং সৌদি আরবে বাইবেল নিষিদ্ধ।
• ইরানে সালমান রুশদির ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ।
• রাশিয়ায় জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ এবং ‘অ্যানিমাল ফার্ম’ একসময় নিষিদ্ধ ছিল।
বাংলাদেশে বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম হলেও কিছু বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় অনুভূতি, রাজনৈতিক বিতর্ক এবং ইতিহাস বিকৃতি—এসব কারণেই মূলত বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে আদালতের মাধ্যমে কিছু নিষেধাজ্ঞা পরবর্তীতে প্রত্যাহার হয়েছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে।
Leave a comment