পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের ওরাকজাই জেলায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় লেফটেন্যান্ট, কর্নেল ও মেজরসহ দেশটির সেনাবাহিনীর ১১ সদস্য নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) গভীর রাতে এ হামলা ঘটেছে বলে বুধবার (৮ অক্টোবর) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখা (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে।
আইএসপিআর জানায়, সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শেষে ঘাঁটিতে ফেরার পথে হামলার শিকার হয়। দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা (IED) বিস্ফোরণের মাধ্যমে একটি সেনা যান উড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। হামলাটি চালিয়েছে ভারত-সমর্থিত সংগঠন ‘ফিতনা আল খারেজ’ এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)।
বিবৃতিতে বলা হয়, হামলায় ঘটনাস্থলেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুনায়েদ তারিক (৩৯) ও মেজর তায়্যব রাহাত (৩৩) নিহত হন। এছাড়াও প্রাণ হারান আরও ৯ জন সেনা সদস্য—নাইব সুবেদার আজম গুল, নায়েক আদিল হুসাইন, নায়েক গুল আমির, ল্যান্স নায়েক শের খান, ল্যান্স নায়েক তালিশ ফারাজ, ল্যান্স নায়েক ইরশাদ হুসাইন, সিপাহী তুফায়েল খান, সিপাহী আকিব আলি ও সিপাহী মোহাম্মদ জাহিদ।
আইএসপিআর আরও জানায়, হামলার আগে ওই এলাকায় পরিচালিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে ১৯ জন জঙ্গিকে হত্যা করা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, পালিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসীরা প্রতিশোধ নিতে ফেরার পথে সেনাবাহিনীর বহরকে লক্ষ্য করে এ হামলা চালায়। ঘটনার পরপরই সেখানে “স্যানিটাইজেশন অপারেশন” শুরু করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, যাতে অবশিষ্ট সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করা যায়।
আইএসপিআর এক বিবৃতিতে জানায়, “আমাদের সেনারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ ধরনের কাপুরুষোচিত হামলা সেনাবাহিনীর মনোবল দুর্বল করতে পারবে না। দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
ঘটনার পর পুরো পাকিস্তানজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “আমাদের সেনাবাহিনীর এই আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যাবে না। ভারত-সমর্থিত সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানের শান্তি নষ্ট করতে চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে আমরা আরও শক্তভাবে দাঁড়াবো।”
প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি নিহত সেনাদের ‘জাতির বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, “লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুনায়েদ ও মেজর তায়্যবসহ শহিদদের আত্মত্যাগ পাকিস্তানের ঐক্য, সাহস ও বীরত্বের প্রতীক।”
পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিও এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং নিহত সেনা সদস্যদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। খাইবার পাখতুনখোয়া ও আশপাশের উপজাতি এলাকাগুলো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে টিটিপি ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর পুনরুত্থানে অস্থির হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠার পর এসব গোষ্ঠী পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
‘ফিতনা আল খারেজ’ নামের এই নতুন গোষ্ঠীটিকে আইএস সমর্থিত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যারা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে একাধিক হামলা চালিয়েছে।
একজন সাবেক সামরিক বিশ্লেষক স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, “ওরাকজাইসহ খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ের হামলাগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে, সন্ত্রাসীরা আবারও সংগঠিত হচ্ছে। সরকারের উচিত সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো।”
পাকিস্তান বিগত দুই দশক ধরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। টিটিপি ও এর সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর হামলায় দেশটির সেনা ও পুলিশ বাহিনীর হাজারো সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। যদিও ২০১৪ সালের পর থেকে দেশটিতে বড় সন্ত্রাসী হামলা অনেকটা কমে গিয়েছিল, তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আবারও হামলার সংখ্যা বেড়েছে।
নিরাপত্তা পর্যবেক্ষকদের মতে, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম বাড়িয়ে তুলেছে।
ওরাকজাই জেলার এই হামলা পাকিস্তানের চলমান নিরাপত্তা সংকটকে নতুন করে উন্মোচন করেছে। সেনাবাহিনীর শীর্ষ দুই কর্মকর্তাসহ ১১ সদস্যের মৃত্যু দেশটিতে শোক ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। সরকার বলছে, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই আরও জোরদার করা হবে এবং শহিদদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।
Leave a comment