পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে। প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (পিডিএমএ) জানিয়েছে, গত ৪৮ ঘণ্টার ভারী বর্ষণ ও আকস্মিক বন্যায় অন্তত ৩০৭ জন নিহত হয়েছেন এবং ২৩ জন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন।
বেশন্ত্রি গ্রামে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে রয়েছে বুনের জেলার বেশন্ত্রি গ্রাম, যা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গ্রামের মসজিদের ইমাম মওলানা আব্দুল সামাদ নিজ পরিবারকে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে তিনি নামাজ শেষে ঘরে ফিরে এসে দেখেন, তার নিজের বাড়িসহ গ্রামের অসংখ্য ঘরবাড়ি পানির তোড়ে ভেসে গেছে। তার পরিবারের পাঁচজন সদস্য এখনো নিখোঁজ।
একই গ্রামের বাসিন্দা সাবেক তহসিল নাজিম আশফাক আহমদ ইসলামাবাদে অবস্থান করছিলেন। বন্যার খবর শুনে দ্রুত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। বাড়ি ফিরে এসে তিনি দেখেন তার পরিবারের ১৪ জনের মধ্যে চারজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, বাকিরা নিখোঁজ।
দাফনের মানুষও নেই
গ্রামটির প্রায় প্রতিটি পরিবারই শোকে মুহ্যমান। এত বেশি মৃত্যু ঘটেছে যে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করার মতো পর্যাপ্ত মানুষ ছিল না। পাশের গ্রামের মানুষ এসে সাহায্য করে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে। স্থানীয় ব্যবসায়ী নূর ইসলাম জানান, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছয়টি কবর খননে সহায়তা করেছেন।
তিনি বলেন, “আমি দুপুরে গ্রামে পৌঁছাই। তখন একটি বাড়িও অক্ষত ছিল না। সর্বত্র ধ্বংসস্তূপ, আহত মানুষ মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে ছিল, আর স্বেচ্ছাসেবীরা মৃতদেহ উদ্ধারে ব্যস্ত ছিল।
নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে
পিডিএমএ জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ২৭৯ জন পুরুষ, ১৫ জন নারী এবং ১৩ জন শিশু। আহতদের মধ্যে রয়েছেন ১৭ জন পুরুষ, চার নারী এবং দুই শিশু। তবে স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে, কারণ বহু মানুষ এখনো নিখোঁজ।
উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, নিখোঁজদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। বুনারের জরুরি উদ্ধার বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বেশন্ত্রি গ্রামের প্রায় এক হাজার অধিবাসীর মধ্যে বহু পরিবার সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত
প্রাদেশিক রেসকিউ সংস্থা জানিয়েছে, দুর্গত এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল সিগন্যাল খুব দুর্বল, আর রাতের অন্ধকারে উদ্ধারকাজ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মৃতদেহ ও আহতদের আনা হচ্ছে।
পিডিএমএ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৭৪টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ১১টি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হলো সোয়াত, বুনের, বাজাউর, তোরঘর, মানসেহরা, শাংলা এবং বটগ্রাম। বাজাউর ও বুনেরে জরুরি ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছে।
সরকারের পদক্ষেপ
খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন। জরুরি বরাদ্দ হিসেবে ৫০ কোটি রুপি ঘোষণা করা হয়েছে—যার মধ্যে বুনের জেলার জন্য ১৫ কোটি, বাজাউর, বটগ্রাম ও মানসেহরা জেলার জন্য ১০ কোটি করে এবং সোয়াত জেলার জন্য পাঁচ কোটি রুপি বরাদ্দ করা হয়েছে।
এছাড়া মহাসড়ক ও সংযোগ সড়ক পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে ত্রাণ ও সহায়তা দ্রুত দুর্গতদের কাছে পৌঁছানো যায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্ক করেছে, আগামী ২১ আগস্ট পর্যন্ত টানা ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে। পিডিএমএ পর্যটক ও স্থানীয়দের সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছে।
বেশন্ত্রি গ্রামের চিত্র আজ যেন এক মৃত্যুপুরি—চারপাশে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর শোকাহত মানুষ। পাকিস্তানে চলমান এই বন্যা শুধু ঘরবাড়ি নয়, অসংখ্য পরিবারকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। মানবিক সহায়তা ছাড়া পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
Leave a comment