প্রেমের টানাপোড়েনের জটিলতায় পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। টিউশনিতে গিয়ে খুন হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসাইন (২১)।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানিয়েছে, প্রেমিকা বারজিস শাবনাম বর্ষাকে (১৯) হারানোর আশঙ্কা থেকেই খুনটি করেন তার দীর্ঘদিনের প্রেমিক মাহির রহমান (১৯)। বংশাল থানা পুলিশের একটি সূত্র সোমবার (২০ অক্টোবর) এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বারজিস শাবনাম বর্ষা গত এক বছর ধরে জোবায়েদের কাছ থেকে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান পড়তেন। ধীরে ধীরে জোবায়েদের প্রতি বর্ষার বিশেষ অনুরাগ জন্ম নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বংশাল থানার এক কর্মকর্তা বলেন, “বর্ষা জোবায়েদকে পছন্দ করতেন। বিষয়টি জানতে পারেন তার প্রেমিক মাহির রহমান, যার সঙ্গে বর্ষার নয় বছরের পুরনো সম্পর্ক ছিল। বর্ষা জোবায়েদের প্রতি ঝোঁক দেখানোর পর সেই সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মাহির পরিকল্পিতভাবে জোবায়েদকে হত্যা করেন।”
মাহির রহমান পুরান ঢাকার শেখ বোরহানউদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের উন্মুক্ত বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি আরমানিটোলার বাসিন্দা এবং বর্ষার পরিবারের কাছাকাছি এলাকায় থাকেন। পুলিশের ধারণা, বর্ষার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ভয়ে ঈর্ষা ও প্রতিশোধপ্রবণতা থেকেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
তদন্তে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, “মাহির আগে থেকেই জোবায়েদ ও বর্ষার সম্পর্ক নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারপর রোববার (১৯ অক্টোবর) বিকেল আনুমানিক ৪টা ৪৫ মিনিটের দিকে আরমানিটোলার নূরবক্স লেনের ‘রৌশান ভিলা’ নামের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে । স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, বিকেল গড়াতেই বর্ষাদের বাসার তিনতলায় চিৎকার শুনে নিচতলায় থাকা এক ভাড়াটিয়া দৌড়ে গিয়ে দেখেন—সিঁড়ি বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে নিচে। তিনতলায় গিয়ে দেখা যায়, জোবায়েদ উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, শরীরজুড়ে ছুরির আঘাত।
অল্প সময়ের মধ্যেই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে। রাত ১০টা ৫০ মিনিটে জোবায়েদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মিডফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, “খুনের আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটি প্রেমঘটিত হত্যাকাণ্ড বলেই মনে হচ্ছে। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চলছে।”
ঘটনার পর রাত ১১টার দিকে পুলিশ বর্ষাকে তাদের বাসা থেকে হেফাজতে নেয়। তাকে দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। এক তদন্ত কর্মকর্তা জানান, “বর্ষা তদন্তে সহযোগিতা করছেন। তিনি জানিয়েছেন, মাহিরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর থেকেই মাহির ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছিলেন।” এদিকে, মাহিরকে গ্রেপ্তারের জন্য একাধিক স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
খুনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মধ্যে নেমে আসে তীব্র ক্ষোভ। রবিবার রাতেই তাঁরা বংশাল থানার সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। “আমরা বিচার চাই, খুনিদের ফাঁসি চাই”—এই স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে তাঁতীবাজার মোড়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখেন প্রায় এক ঘণ্টা। পরে পুলিশের আশ্বাসে তারা অবরোধ তুলে নেয়।
জোবায়েদ হোসাইন ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯–২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি কুমিল্লা জেলা ছাত্র কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন।
সহপাঠীরা জানান, জোবায়েদ ছিলেন শান্ত, মেধাবী এবং দায়িত্বশীল ছাত্রনেতা। এক সহপাঠী বলেন, “সে কখনো কারও সঙ্গে ঝামেলায় জড়ায়নি। তার মৃত্যু আমাদের জন্য ব্যক্তিগত ও সংগঠনিকভাবে অপূরণীয় ক্ষতি।” বংশাল থানার কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা হত্যার পেছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখছি। প্রেমঘটিত কারণ স্পষ্ট হলেও, এতে অন্য কোনো জটিলতা ছিল কিনা, সেটিও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “মাহিরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আমরা আশা করছি, খুব শিগগিরই তাকে আইনের আওতায় আনা যাবে।” এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েদা ইসলাম বলেন, “প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনাকে অনেকে মানসিকভাবে সামলাতে পারেন না। সমাজে আবেগ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা এখন অত্যন্ত জরুরি।”
আরমানিটোলার এই হত্যাকাণ্ড কেবল এক তরুণ ছাত্রনেতার প্রাণ কেড়ে নেয়নি, বরং উন্মোচন করেছে তরুণ সমাজে সম্পর্ক, ঈর্ষা ও মানসিক অস্থিরতার ভয়াবহ বাস্তবতা। পুলিশ বলছে, দ্রুত তদন্ত শেষ করে জোবায়েদ হত্যার নেপথ্যের সব রহস্য উদঘাটন করা হবে।
Leave a comment