বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এই আদেশটি জনসাধারণের অবগতির জন্য সরকারি গেজেটে প্রকাশ করেছে।
আদেশে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থান জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়কে প্রতিফলিত করে। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটে, পরদিন জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন ও সংস্কারের লক্ষ্যে ছয়টি পৃথক কমিশন গঠন করে—
১️. সংবিধান সংস্কার কমিশন
২️. নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন
৩️. জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন
৪️. বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন
৫️. পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন
৬️. দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন
এসব কমিশন তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে সুশাসন, জবাবদিহিতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ও নাগরিক স্বাধীনতা সুরক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়। এই ছয় কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সরকার ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে। কমিশনটি গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা চালায় এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ প্রস্তাব প্রণয়ন করে।
ফলস্বরূপ ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নামে একটি ঐতিহাসিক নথি প্রণীত হয়, যাতে সব অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোট স্বাক্ষর করে এবং তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ঘোষণা করে।
আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন জনগণের অনুমোদন ছাড়া কার্যকর করা যাবে না। এজন্য জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের অংশ হিসেবে গণভোট আয়োজন এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন অপরিহার্য বলে আদেশে বলা হয়েছে।
এই পরিষদ গণভোটের ফলাফল ও জনগণের অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন সংবিধান সংস্কারের কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। এতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারি করেছেন। আদেশটি মূলত সংবিধান সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন কার্যক্রমকে সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান করেছে।
সরকারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মের গণতন্ত্রের সূচনা হতে পারে, যেখানে জনগণের সরাসরি মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সংবিধান রচিত হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েম রহমান বলেন,“এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বা আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং জনগণের ইচ্ছা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের প্রতীক।
অন্যদিকে, কিছু সমালোচক সতর্ক করেছেন যে, সংস্কার প্রক্রিয়া যেন রাজনৈতিক স্বার্থে প্রভাবিত না হয় এবং এর প্রতিটি ধাপ স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়। তারা মনে করেন, গণভোট ও পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও মানবাধিকার নীতি নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন সংবিধান সংস্কার কেবল রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করবে না, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দিকেও নতুন দিগন্ত খুলবে। এতে স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ, দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ এবং বিচার বিভাগকে আরও স্বাধীন করার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সনদ বাস্তবায়ন কার্যক্রমে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে—যাতে এই সংস্কার কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপ না হয়ে জাতির সম্মিলিত অঙ্গীকারে পরিণত হয়।
‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নতুন যাত্রার সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থনের চেতনায় প্রণীত এই আদেশ যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি স্থায়ী পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে পারে।
Leave a comment