জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় দায়ের করা আলোচিত মামলার রায় আজ সোমবার ঘোষণা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের রায়কে ঘিরে পুরো দেশজুড়েই উত্তেজনা ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল রেজিস্ট্রার কার্যালয় জানিয়েছে, সকাল ১১টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হবে এবং রায় ঘোষণার পুরো প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) সরাসরি সম্প্রচার করবে। বিচার প্রক্রিয়াকে গণমাধ্যমের জন্য উন্মুক্ত রাখার সিদ্ধান্তকে সরকার “স্বচ্ছতার অংশ” হিসেবে দেখছে। রাজধানীর একাধিক স্থানে বড় পর্দায় সরাসরি রায় দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, যাতে সাধারণ মানুষও এই বিচার প্রক্রিয়ার সাক্ষী হতে পারে।
রায় ঘোষণাকে সামনে রেখে ট্রাইব্যুনাল এলাকা ও সংলগ্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দোয়েল চত্বর থেকে শিক্ষাভবনমুখী সড়ক সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনী মোতায়েনের জন্য সামরিক সদর দপ্তরে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়েছে, যা বর্তমানে পর্যালোচনায় রয়েছে।
নিরাপত্তা ও বিচার প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বিবেচনায় বিদেশি কূটনীতিকসহ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আজকের রায়ের দিকে নিবদ্ধ রয়েছে।
প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ অনুযায়ী শেখ হাসিনা ও অন্য দুই আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগগুলো হলো—
(.)১৪ জুলাই গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান
(.)হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূলের নির্দেশ
(.)রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা
(.)চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা
(.)আশুলিয়ায় ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান মামলার শুরু থেকেই পলাতক আসামি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। অপরদিকে, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালের একমাত্র গ্রেফতার আসামি। অভিযোগ গঠনের দিন তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন এবং ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ার আবেদন করেন। তাঁর আইনজীবী শেষ যুক্তিতর্কে মামুনের খালাস চান।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম মামলা হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই মিসকেসটি দায়ের করা হয়।
এরপর—
• ১৭ অক্টোবর ২০২৪: প্রথম বিচারকাজ শুরু
• ১০ জুলাই ২০২৫: আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন
• ১২ মে ২০২৫: তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা
• ১২ অক্টোবর ২০২৫: যুক্তিতর্ক শুরু
• ২৩ অক্টোবর ২০২৫: যুক্তিতর্ক সমাপ্ত
রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম যুক্তিতর্কে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন, যা মামলাকে আরও আলোচিত করে তোলে।
আসামি পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন শেষ যুক্তিতর্কে বলেন, অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। তিনি মামলার সম্পূর্ণ খালাস দাবি করেন। একইভাবে রাজসাক্ষী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে তাঁর আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদও খালাস আবেদন করেন।
আজকের রায় শুধু তিন আসামির ভাগ্য নির্ধারণ করবে না, বরং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিচার-ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠবে—এমনটাই মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর থাকায় এই রায়ের গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
Leave a comment