বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্পের যে ধারাবাহিক তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নিয়ে গবেষক ও সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ বাড়ছে। এরই মাঝে জনপ্রিয় ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ সাইট আর্থকোয়াকট্র্যাকার ডটকম জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বের অন্তত ১৩৩টি স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকেলে প্রকাশিত আপডেট অনুযায়ী, এ সংখ্যা পৃথিবীর ভৌগোলিক অস্থিরতার একটি নতুন ইঙ্গিত বহন করছে।
আর্থকোয়াকট্র্যাকার-এর তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২৪ ঘণ্টার হিসাবই নয়—গত সাত দিনে বিশ্বজুড়ে ৮৫৪টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। একইসঙ্গে গত এক মাসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৫৫৮৯-এ। বিভিন্ন ফল্ট লাইনের ওপর ক্রমবর্ধমান কম্পন বা সিসমিক মুভমেন্ট ইঙ্গিত দেয় পৃথিবীর অভ্যন্তরে শক্তি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে।
ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত মাঝারি ও ছোট মাত্রার ভূমিকম্প বেশি হলে তা কখনও কখনও বড় ধরনের কম্পনের আগাম সংকেত হতে পারে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল বা ফল্ট লাইন রয়েছে, সেখানে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের পাশাপাশি বাংলাদেশেও গত কয়েক সপ্তাহে ভূমিকম্পের ঘনঘটা বেড়েছে। গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) দেশে ৫.৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যা ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকাকে কাঁপিয়ে দেয়। এর পরদিন শনিবার আরও তিনটি মৃদু ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়।
এসব ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী সক্রিয় ফল্ট জোনের কারণে বাংলাদেশ একটি মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প প্রবণ দেশ। দেশটির উত্তর-পূর্ব অংশ, চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং ঢাকার চারপাশে নতুন করে সিসমিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্প বৃদ্ধিকে অনেক গবেষক স্বাভাবিক ভূ-তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখলেও, একাধিক অঞ্চলে একই সময়ে তীব্র সিসমিক মুভমেন্ট দেখা গেলে তা উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। কারণ, ভূমিকম্পের সময় টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার মাধ্যমে সঞ্চিত শক্তি বেরিয়ে আসে। যখন বড় মাত্রায় শক্তি জমে থাকে, তখন মাঝারি-ছোট কম্পনের পর কোনো অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ভূমিকম্প বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে মত দিয়েছেন—“ছোট কম্পনগুলো কখনো কখনো চাপ মুক্ত করে, আবার কখনো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাসও হতে পারে। অঞ্চলভেদে এর ধরন ভিন্ন। তাই সঠিক পর্যবেক্ষণই সিদ্ধান্তের মূল চাবিকাঠি।”
গবেষণায় দেখা গেছে, প্যাসিফিক ‘রিং অফ ফায়ার’, হিমালয়ান বেল্ট, ইরান-তুরস্ক অঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি জায়গা বর্তমানে অতিরিক্ত সিসমিক চাপের মধ্যে রয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ১৩৩টি ভূমিকম্পের ঘটনা জানাচ্ছে যে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা আগের তুলনায় সক্রিয়।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তা এবং পৃথিবীর তাপমাত্রাজনিত ভূতাত্ত্বিক প্রভাবগুলো মিলেও সিসমিক মুভমেন্ট বাড়তে পারে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভূমিকম্প সচেতনতা ও প্রস্তুতি তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
• ভবনের কাঠামোগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে
• পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন দ্রুত সংস্কার বা অপসারণ প্রয়োজন
• স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প মহড়া বাধ্যতামূলক করা উচিত
• জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা জরুরি
• জনসাধারণকে নিয়মিত সচেতনতা বাড়াতে হবে
গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে ১৩৩টি ভূমিকম্পের ঘটনা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি পৃথিবীর ভৌগোলিক সক্রিয়তার একটি স্পষ্ট সংকেত। বাংলাদেশেও ঘনঘন ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় সচেতনতা আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও আগাম প্রস্তুতি ও সঠিক পরিকল্পনা প্রাণহানি ও ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
Leave a comment