বাংলাদেশ সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেশে ফেরত পাঠাতে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে। শুক্রবার (২১ নভেম্বর) এই সংক্রান্ত পত্র দিল্লিতে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
রোববার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “দণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। রায় কার্যকরের জন্য তাদের ফেরত চেয়ে ভারত সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠানো হয়েছে।” এই পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক মাধ্যমে দুই সাবেক রাষ্ট্রনেতাকে প্রত্যর্পণের জন্য চেষ্টা শুরু করল। ভারতের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।
১৭ নভেম্বর পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধেও ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।
মামলার অপর আসামি, পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় তিনি আদালতে উপস্থিত থাকলেও হাসিনা ও কামাল ভারতে অবস্থানের কারণে অনুপস্থিত ছিলেন।
৪৫৩ পৃষ্ঠার এই গুরুত্বপূর্ণ রায়ে ছয়টি মূল অংশ থাকে এবং পুরো কার্যক্রম ট্রাইব্যুনাল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। রায়ে বলা হয়, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় “নৃশংস ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ ও অনুমোদন দেওয়ার মাধ্যমে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি” প্রমাণিত হয়েছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আসামিদের সর্বোচ্চ দণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল।
দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর থেকেই তিনি ও কামাল ভারতে অবস্থান করছেন। দেশের ইতিহাসে এটি প্রথম ঘটনা, যখন কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলেন।
এর আগে, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী আদালতের অবমাননার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিল। রায় ঘোষণার পর থেকেই দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে বহুল আলোচিত প্রশ্ন ছিল—ভারত কি শেখ হাসিনা ও কামালকে ফেরত দেবে? তাদের অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করা হলেও, কার্যকর করতে হলে প্রত্যর্পণের বিষয়টি অনিবার্য হয়ে ওঠে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান, সব আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করেই দিল্লির উদ্দেশে প্রত্যর্পণ অনুরোধ পাঠানো হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, বিষয়টি জটিল এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর ওপর নির্ভর করবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশের অনুরোধটি আন্তর্জাতিক আইন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং মানবাধিকার-সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতার আলোচনাকেও সামনে এনেছে। বিশেষত অভিযুক্তরা যখন রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রক্রিয়ায় থাকতে পারেন—তখন প্রত্যর্পণের প্রশ্নটি আরও স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে।
সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র বলছে, দিল্লির আনুষ্ঠানিক জবাব না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশ অপেক্ষা করবে। অপরদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রায় কার্যকরের বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা ও বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু আইনগত নয়—আঞ্চলিক ভূরাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে দাঁড়াবে।
Leave a comment