দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা নতুন ঘটনা নয়। ক্ষমতায় থাকা কিংবা ক্ষমতা হারানোর পর নানা অভিযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার পালাবদলের জটিলতায় এ অঞ্চলের বেশ কয়েকজন শাসক, বিচারিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ের প্রেক্ষাপটে অতীতের এসব মামলার আলোচনা নতুন করে সামনে এসেছে। শেখ হাসিনার আগে উপমহাদেশে পাকিস্তানের দুই আলোচিত শাসক—জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পারভেজ মোশাররফ—একই ধরনের রায়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে আলোচিত মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা ছিল ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি।
জুলফিকার আলী ভুট্টো: রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হত্যার অভিযোগে ফাঁসি
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৭৭ সালে জিয়াউল হকের সামরিক অভ্যুত্থানে ভুট্টো ক্ষমতাচ্যুত হন। ক্ষমতাচ্যুতি–পরবর্তী অস্থিরতায় তাকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। দুই বছরের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৭৯ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ৪ এপ্রিল ১৯৭৯ ভোরে রাওয়ালপিন্ডি কারাগারে ভুট্টোর ফাঁসি কার্যকর হয়।তার পরিবার ও সমর্থকেরা দীর্ঘদিন ধরে এ রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে আসছিলেন। সেই বিতর্ক আরও দৃঢ় হয় ২০২৪ সালে, যখন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করে—ভুট্টো ‘ন্যায্য বিচার’ পাননি। একইসঙ্গে তারা জানান, বিচার প্রক্রিয়ায় গুরুতর ত্রুটি ছিল, যা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে।
পারভেজ মোশাররফ: রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়
পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফও বিচারিক ইতিহাসে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আলোচিত নাম। ২০০৭ সালে সংবিধান স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারি ও বিচারপতিদের গৃহবন্দী করার মতো পদক্ষেপের কারণে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অভিযোগ আনা হয়। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একটি বিশেষ আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায় ঘোষণার সময় মোশাররফ সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছিলেন । ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুবাইয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ফলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
মোশাররফের রায় পাকিস্তানে ব্যাপক রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং দেশটির সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দেয়।
সাদ্দাম হোসেন: মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও নির্মোহভাবে নথিভুক্ত মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা হলো ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি। ১৯৭৯ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ইরাক শাসন করা সাদ্দাম মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা এবং রাজনৈতিক দমন–পীড়নের অসংখ্য অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। দুজাইল শহরে শিয়া জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং কুর্দি অধ্যুষিত হালাবজায় রাসায়নিক হামলার অভিযোগ বিশেষভাবে আলোচিত ছিল।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর আক্রমণের পর সাদ্দামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক বছর পর, অর্থাৎ ২০০৫ সালে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার পর ২০০৬ সালের নভেম্বরে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং পরের মাস, ৩০ ডিসেম্বর—ঈদুল আজহার সকালে—ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ঘটনাকে কেউ মানবতার স্বস্তি, কেউ আবার আন্তর্জাতিক রাজনীতির কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখেছেন। এখনো তার ফাঁসিকে ঘিরে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে নানা বিতর্ক বিদ্যমান।
রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলে মৃত্যুদণ্ড: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
ইতিহাস বলে, ক্ষমতার শীর্ষে থাকা নেতার পতন কখনো কখনো তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, সামরিক হস্তক্ষেপ বা রাজনৈতিক বিদ্বেষের জন্ম দেয়। দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক কাঠামোতে সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক অস্থিরতা, দুর্বল বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রতিশোধ—এ সবকিছু মিলে বহু নেতা মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর রায়ের সম্মুখীন হয়েছেন।
যদিও প্রতিটি মামলা আলাদা, অভিযোগ ভিন্ন এবং প্রেক্ষাপট জটিল, তবুও একটি বিষয় সাধারণ—ক্ষমতার পরিবর্তন রাজনৈতিক বিচারের প্রকৃতি ও দিক নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ের প্রেক্ষিতে অতীতের এই ঘটনাগুলো আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। ভুট্টো থেকে মোশাররফ কিংবা সাদ্দাম—বিচার, রাজনীতি, ক্ষমতা ও ইতিহাসের টানাপড়েনে তারা হয়েছিলেন বিচারিক রায়ের মুখোমুখি। তাদের ঘটনাপ্রবাহ শুধু আঞ্চলিক রাজনীতির ইতিহাসই নয়, রাষ্ট্রক্ষমতা ও বিচারব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে—যা আজও প্রাসঙ্গিক।



Leave a comment