পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে জেলা ও সেশন কোর্ট ভবনের বাইরে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত এবং আরও ৩৬ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৩৯ মিনিটে শহরের ব্যস্ত আদালত চত্বরে এই বিস্ফোরণ ঘটে।
পাকিস্তান সরকার ঘটনাটিকে “পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ” আখ্যা দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তুলেছে। সরকার বলছে, ভারত-সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ফেডারেল রাজধানীকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালিয়েছে।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি জানান, হামলাটি ছিল একটি আত্মঘাতী বিস্ফোরণ। হামলাকারী প্রায় ১২ মিনিট ধরে আদালতের মূল ফটকের বাইরে অবস্থান করে। প্রাথমিকভাবে আদালতের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়ে সে একটি পুলিশ ভ্যানের কাছে গিয়ে নিজেকে বিস্ফোরণ ঘটায়।
নাকভি বলেন,“এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ফেডারেল রাজধানী ইসলামাবাদকে টার্গেট করে সুচিন্তিত পরিকল্পনায় এই হামলা চালানো হয়েছে।”
বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে নিরাপত্তা বাহিনী। আহতদের দ্রুত ইসলামাবাদের পিমস ও শিফা হাসপাতালসহ বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া হয়। বিস্ফোরণের তীব্রতায় আশপাশের দোকান ও যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এক বিবৃতিতে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন,“ভারতীয় সমর্থনে সক্রিয় ‘ফিতনা-আল-খারিজ’ গোষ্ঠী এই নৃশংস হামলা চালিয়েছে। নিরীহ মানুষকে হত্যা করে তারা পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।”
তিনি নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিতের নির্দেশ দেন।
সরকারের জারি করা এক বিবৃতিতে আরও বলা হয়,“আফগানিস্তান থেকে সক্রিয় ভারতীয় প্ররোচনায় পরিচালিত সন্ত্রাসীরা ওয়ানায় শিশুদের ওপর হামলা চালানোর পর এবার রাজধানীকেই লক্ষ্য করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এমন রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের নিন্দা করা।”
সরকারি বিবৃতিতে ব্যবহৃত ‘ফিতনা-আল-খারিজ’ শব্দটি পাকিস্তানি তালেবান নামে পরিচিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই গোষ্ঠী সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক হামলার দায় স্বীকার করেছে।
অন্যদিকে ‘ফিতনা-আল-হিন্দুস্তান’ বলতে বোঝানো হয় বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে, যাদের তৎপরতার পেছনে ভারতের আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা রয়েছে বলে পাকিস্তানের দাবি।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকভি জানান, প্রাথমিক তদন্তে আফগান সীমান্তের দিক থেকে হামলাকারীর আগমনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আত্তাউল্লা তারার দেশটির বেসরকারি টেলিভিশন জিও নিউজ-কে বলেন,“এ ধরনের হামলা আফগান মাটির ব্যবহার বা সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। যখনই আমরা সন্ত্রাসীদের আটক করি, দেখা যায় তাদের মধ্যে আফগান নাগরিকও থাকে।”
এই অভিযোগের বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অতীতের অনুরূপ ঘটনায় নয়াদিল্লি বরাবরই পাকিস্তানের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে।
ঘটনার পর জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসলামাবাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে। আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী সরকারও এক বিবৃতিতে “নিরপরাধ নাগরিকদের হত্যার” সমালোচনা করেছে এবং পাকিস্তানের অভিযোগ তদন্তে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক রাহিম ইউসুফজাই বলেন,“ইসলামাবাদের মতো কড়া নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় আত্মঘাতী হামলা স্পষ্ট করে যে, সন্ত্রাসীরা এখনো সক্রিয় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমর্থন পাচ্ছে। যদি পাকিস্তান সত্যিই ভারতের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দিতে পারে, তাহলে এই ঘটনা আঞ্চলিক রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে।”
এই বিস্ফোরণ শুধু পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেনি, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে কূটনৈতিক উত্তেজনার আশঙ্কা জাগিয়েছে।
সূত্র: ডন, জিও নিউজ, দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন
Leave a comment