ইরানে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ছবি পুড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার এক সপ্তাহ পর রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছেন এক তরুণ। পশ্চিম ইরানের লোরেস্তান প্রদেশে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ওই যুবকের মরদেহ। নিহতের নাম ওমিদ সারলাক (২০)। ঘটনাটি দেশটিতে নতুন করে উত্তেজনা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
ইরানের বিরোধী গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, গত শুক্রবার ওমিদ সারলাক নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একটি ছবি পোস্ট করেন। সেখানে দেখা যায়, তিনি একটি বনে দাঁড়িয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ছবি আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন। পোস্টটি ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই রহস্যজনকভাবে তার অবস্থান অজানা হয়ে যায়।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ (IRNA) জানিয়েছে, ওমিদের মরদেহ একটি গাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থলেই একটি পিস্তল পাওয়া গেছে। পুলিশপ্রধান আলি আসাদোল্লাহি দাবি করেছেন, সারলাক আত্মহত্যা করেছেন। তবে বিরোধীরা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের অভিযোগ, এটি আত্মহত্যা নয়—একটি পরিকল্পিত হত্যা, যার পেছনে ইরানি কর্তৃপক্ষের হাত রয়েছে।
সোমবার সারলাকের জানাজায় অংশ নেওয়া শতাধিক মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা “ওমিদকে হত্যা করা হয়েছে” বলে স্লোগান দিতে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়, স্থানীয়রা ‘খামেনিকে হত্যাকারী’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন।
ভিডিওগুলো ইরানের বাইরে থেকে পরিচালিত দুটি গণমাধ্যম—ইরান ইন্টারন্যাশনাল ও রেডিও ফারদা—প্রচার করে।
আরেকটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, সারলাক গাড়িতে বসে সাবেক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির কণ্ঠে একটি রেকর্ড শুনছেন। এতে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি রাজতন্ত্রপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত শাহের ছেলে রেজা পাহলভি সামাজিক মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন, “ওমিদ সারলাক ইসলামি প্রজাতন্ত্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।”
ইরানের আধা-সরকারি তাসনিম নিউজ এজেন্সি বিরোধীদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, সারলাকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগ ছিল না। তাদের দাবি, তিনি ব্যক্তিগত কারণে আত্মহত্যা করেছেন। এদিকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো একটি ভিডিওতে ওমিদের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে।” তবে পরবর্তীতে স্থানীয় টেলিভিশনে তিনি বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ার খবর বিশ্বাস করবেন না।” তার এই দুটি বিপরীত বক্তব্য আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইরান সরকার সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভিন্নমত দমনে আরও কঠোর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে চলতি বছরের জুনে ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের পর থেকে দেশজুড়ে বিরোধী কণ্ঠ দমন অভিযান জোরদার করা হয়েছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের মানবাধিকার বিশেষ দূত মাই সাতো সতর্ক করেছেন, দেশটিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, নির্বিচারে গ্রেফতার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে।
ওমিদ সারলাকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও প্রবাসী ইরানিরা সরকারের বিরুদ্ধে *“অবাধ হত্যা” ও “রাজনৈতিক দমননীতি”*র অভিযোগ তুলেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এক বিবৃতিতে বলেছে, “ইরানে সরকারবিরোধী মত প্রকাশের শাস্তি এখন মৃত্যুর সমান।”
খামেনির ছবি পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানানো এক তরুণের মৃত্যু ইরানে ক্রমবর্ধমান দমননীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। সরকার আত্মহত্যার দাবি করলেও, বিরোধীরা বলছে এটি স্পষ্ট রাজনৈতিক হত্যা।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে নতুন করে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে আবারও প্রশ্ন উঠেছে—ইরানে ভিন্নমতের কণ্ঠ কি আদৌ নিরাপদ?
Leave a comment