দক্ষিণ এশিয়ার পার্বত্য দেশ নেপাল ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং অঞ্চলে টানা ভারী বৃষ্টিপাতে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধস। ইতিমধ্যে নেপালে অন্তত ৪৭ জন এবং ভারতে সাতজনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নিখোঁজ রয়েছেন আরও অন্তত ১১ জন।
রোববার (৫ অক্টোবর) স্থানীয় সময় সকালে নেপালের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও ভারতের রাজ্য প্রশাসন এক যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে জানানো হয়— বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে নেপালের অন্তত আটটি জেলা ও ভারতের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নেপালের সশস্ত্র পুলিশের মুখপাত্র কালিদাস ধাউবোজি জানান, পূর্বাঞ্চলীয় ইলাম জেলায় একাধিক ভূমিধসে অন্তত ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বজ্রপাতে তিনজন এবং উদয়পুর জেলায় বন্যায় আরও একজন মারা গেছেন।
তিনি বলেন, “টানা বর্ষণে ভূমিধস বাড়ছে। অনেক গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উদ্ধারকাজ অব্যাহত থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে।”
রোববার বিকেলে নেপালের হাইড্রোলজি অ্যান্ড মেটিওরোলজি বিভাগ জানায়, দেশটির অন্তত আটটি প্রধান নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে। এর মধ্যে বাগমতী, সুন কোশি, অরুণ, তামোর, কোশি, বুড়িখোলা ও বিরিং খোলা নদীগুলো সবচেয়ে বেশি ফুলে উঠেছে।
বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব নেপালের কোশি নদীর পানি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় কোশি ব্যারেজের সব ৫৬টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে অতিরিক্ত পানির চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
নেপালের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা, সেতু ও বিদ্যুৎ লাইন ভেঙে গেছে, ফলে শত শত মানুষ আটকা পড়েছেন। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে।কাঠমান্ডু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মুখপাত্র রিঞ্জি শেরপা জানান, “দেশের ভেতরে যাত্রীবাহী ফ্লাইটগুলো মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এখন পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে চলছে।”অন্যদিকে, দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র জানিয়েছে, নিখোঁজদের উদ্ধারে সেনা, পুলিশ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা যৌথভাবে অভিযান চালাচ্ছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পার্বত্য জেলা দার্জিলিংয়েও ভূমিধসের ভয়াবহতা দেখা দিয়েছে। জেলার পুলিশ কর্মকর্তা অভিষেক রায় জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত সাতজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “ এখনও দুজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। উদ্ধার অভিযান চলছে। ভারী বৃষ্টির কারণে উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”
স্থানীয় প্রশাসন জানায়, পাহাড় ধসে ঘরবাড়ি, সড়ক ও চা-বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশ কয়েকটি এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
নেপালের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী সোমবার (৬ অক্টোবর) পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে, যা আরও বন্যা ও ভূমিধসের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের সতর্ক করে বলেছে, পাহাড়ি ঢাল, নদীর পাড় ও নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারীরা যেন নিরাপদ স্থানে চলে যান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে এ ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নেপালের ভূগোল বিশেষজ্ঞ ড. সুদীপ গৌতম বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের ধরণ অস্বাভাবিকভাবে বদলে যাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে, যা পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “নেপাল ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় যৌথ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়ছে।”
নেপাল সরকার ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। সেনাবাহিনী ও রেড ক্রসের সদস্যরা দুর্গত এলাকায় খাদ্য, ওষুধ ও আশ্রয়সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস (IFRC) ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় জরুরি তহবিল ঘোষণা করেছে।
ভারতের দার্জিলিংয়েও রাজ্য প্রশাসন দুর্গতদের পুনর্বাসনে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে।
টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট এই বন্যা ও ভূমিধস নেপাল এবং ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে বহু প্রাণহানি, অবকাঠামোগত ক্ষতি এবং মানবিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, দক্ষিণ এশিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারে।
Leave a comment