৩ মার্চ, ১৭০৭—ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই দিনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আওরঙ্গজেব, যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে ভারত শাসন করেছেন। ইতিহাসে তাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হলেও, তার প্রশাসনিক দক্ষতা, সামরিক কৌশল, এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ভারতীয় উপমহাদেশকে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত করেছিল।
আওরঙ্গজেব ছিলেন এক ব্যতিক্রমী মুঘল সম্রাট, যিনি বিলাসিতার বিপরীতে কঠোর শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক দক্ষতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা তার সামরিক নীতির সফলতার পরিচায়ক। তার শাসনামলে দক্ষিণ ভারতে মুঘল প্রভাব সুসংহত হয়, বিশেষ করে দাক্ষিণাত্যের বিজয়ের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের সীমানা অনেকদূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল।
তৎকালীন সময়ে আওরঙ্গজেব প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও দক্ষ করার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম চালান। তিনি রাজস্ব ব্যবস্থাকে সুসংহত করেন, কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটান এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর নীতি গ্রহণ করেন।
অর্থনীতি ও বিচারব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন
সম্রাট আওরঙ্গজেব কর ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনেন। তিনি ‘ইনাম’ নামে রাজস্ব সংগ্রহের নতুন নীতি প্রবর্তন করেন, যা কৃষকদের ওপর করের চাপ কমিয়ে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করেছিল। তার শাসনামলে রাজকোষ ছিল বেশ সমৃদ্ধ, যা সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল।
এছাড়া, তিনি বিচার ব্যবস্থায় কঠোরতা আরোপ করে অপরাধ দমনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তার শাসনামলে ভারতে সুসংহত আইন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা অনেকাংশেই মুঘল প্রশাসনের ভিত্তিকে দৃঢ় করেছিল।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সামাজিক সংস্কার
যদিও অনেক ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একপাক্ষিকভাবে বিচার করেছেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মন্দির ধ্বংসের বদলে বহু মন্দিরকে রাজকীয় অনুদান দিয়েছেন, যা প্রমাণ করে যে তার শাসন শুধুমাত্র ধর্মীয় গোঁড়ামির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়নি।
এক মহাশক্তির পতন
তবে দীর্ঘকালীন যুদ্ধ, প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ ও বিদ্রোহ দমনে অতি-কঠোরতা তার শাসনামলকে দুর্বল করে তুলেছিল। ৩ মার্চ, ১৭০৭ সালে, ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই মহাশাসক। মৃত্যুর পরপরই তার তিন পুত্রের মধ্যে সিংহাসনের জন্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা মুঘল সাম্রাজ্যের ক্রমশ পতনের সূচনা করে।
আওরঙ্গজেব ছিলেন এক কঠোর, পরিশ্রমী এবং অদম্য শাসক, যার শাসনামলে ভারতবর্ষ সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। যদিও তার নীতিগুলো বিতর্কিত, তবে তার শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির জন্য তাকে ভারতবর্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। তবে তার রেখে যাওয়া প্রশাসনিক কাঠামো, নীতি ও ঐতিহ্য ভারতবর্ষের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
Leave a comment