দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যখন উত্তপ্ত, রাস্তায় চলছে বিক্ষোভ, উচ্চস্বরে উঠছে সরকারের উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি—ঠিক সেই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে একে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, জামায়াতে ইসলামীর আমির, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির নেতারা। তাঁরা কেউ সরাসরি ক্ষমতায় থাকা অবস্থার দায় নিচ্ছেন, কেউ বিভেদের জন্য দুঃখপ্রকাশ করছেন, কেউ আবার সতর্ক করছেন ঐক্য বিনষ্টের বিপদ সম্পর্কে।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়কালে একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাঁদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও অ্যাকাউন্টে দেওয়া পোস্টে এমন বক্তব্য তুলে ধরেন। সবচেয়ে আলোচিত পোস্টটি আসে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কাছ থেকে। বিকেল পাঁচটার দিকে দেওয়া পোস্টে তিনি লেখেন, ‘ব্যক্তির আদর্শ, সম্মান ও আবেগের চেয়ে দেশ বড়। দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য।’ অতীতের বিভাজনমূলক বক্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশও করেন তিনি।
মাহফুজ আলম আরও বলেন, সরকারে আরও এক দিন থাকলেও তিনি অভ্যুত্থানের শক্তির প্রতি সম্মান রেখে কাজ করতে চান। পুরোনো বিভেদ ও স্লোগান এড়িয়ে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে চান তিনি। তাঁর মতে, বাংলাদেশ এখন গভীর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—এটি ঐক্য ও ধৈর্যের পরীক্ষা।
তাঁর এই পোস্ট আসে এমন সময়, যখন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ, ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার বিচার এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবিতে রাজধানীজুড়ে আন্দোলন চলছে। একইসঙ্গে এনসিপির পক্ষ থেকেও নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে উপদেষ্টার এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এদিনই জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান দুটি পোস্টে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি লেখেন, ‘জাতীয় স্বার্থে স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।’ আরেক পোস্টে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল পক্ষকে মান-অভিমান ভুলে দায়িত্বশীল হতে হবে।’
একইসঙ্গে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ফেসবুকে লেখেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধীরা মতাদর্শগত ভিন্নতা ভুলে দেশকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে সেটিরই সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে। এখন কেউ এই যাত্রাকে ব্যাহত করতে পারবে না।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু আরও স্পষ্ট ভাষায় লেখেন, ‘জুলাই-আগস্টে আমরা সবাই মিলে ফ্যাসিবাদের মূল উপড়ে ফেলেছিলাম। এখন আমরা সবাই মিলে অমার্জনীয় ভুল করছি।’
নাম না নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘টাকা আর সুপারিশে আওয়ামী লীগের দাগী আসামিরা জামিন পায়, অথচ মজলুম আলেমরা আজও কারাগারে। শাপলা হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি।’ এরপর তিনি আইন উপদেষ্টা হিসেবে আসিফ নজরুলের দায়ের প্রশ্ন তোলেন—‘এই দায় তিনি কি এড়াতে পারেন?’
একইভাবে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়া এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির চক্রান্ত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সালিশের সুযোগ দিয়ে যেন আবার কোনো ওয়ান-ইলেভেনের পথ কেউ না তৈরি করে।’
তিনি আরও দাবি করেন, এনসিপিকে নির্বাচনবিরোধী বলে কলঙ্ক দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের পর যে সম্ভাবনার দরজা খুলেছিল, বিভাজনের কারণে সেই সুযোগ নষ্ট হলে সেটি হবে ঐতিহাসিক ব্যর্থতা।
সবশেষে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ লেখেন, ‘নিজ স্বার্থে আপনারাই জুলাইকে ধ্বংস করেছেন। বহুবার সতর্ক করেছি, কিন্তু দেখেছি অহংকার আর স্বেচ্ছাচার।’ তিনি গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এই সব ফেসবুক পোস্টে একটি মিল লক্ষ্য করা যাচ্ছে—বিভিন্ন মতাদর্শের হলেও সবাই কিছু না কিছু দায় নিচ্ছেন, মতভেদ ভুলে ঐক্য গঠনের আহ্বান জানাচ্ছেন। এর মাধ্যমে একটি স্পষ্ট সংকেত মিলছে—বহু কণ্ঠে একটি বার্তা, পরিস্থিতি আর উত্তপ্ত হওয়া নয়, এবার প্রয়োজন সহনশীলতা ও সমঝোতা। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব ফেসবুক পোস্টের বাস্তব রূপান্তর ঘটানো না গেলে সংকট শুধু পোস্টে নয়, রাজপথেও বহাল থাকবে।
Leave a comment