বাংলাদেশ ইস্যুতে আবারও কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা ও বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট জবাব না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন আরও তীব্র করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানান শুভেন্দু।
মঙ্গলবার কলকাতায় বিজেপির রাজ্য দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “বাংলাদেশে দীপু দাস হত্যার ঘটনায় হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—এই বিষয়ে যতক্ষণ না বাংলাদেশ উপদূতাবাস থেকে পরিষ্কার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে এবং আরও জোরদার হবে।”
কলকাতাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের ময়মনসিংহে দীপু দাস নামে এক যুবককে হত্যা করে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ও বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিবাদ তীব্র হয়ে উঠেছে।
এ প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, এবিভিপি ও হিন্দু জাগরণ মঞ্চসহ একাধিক সংগঠনের ডাকে কলকাতায় বাংলাদেশের উপদূতাবাস অভিমুখে অভিযানের কর্মসূচি পালিত হয়। তবে উপদূতাবাস এলাকায় পৌঁছানোর আগেই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের আটকে দেয়। এ সময় বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এই ঘটনায় রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে শুভেন্দু অধিকারী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “উপদূতাবাসে আমাদের ঢুকতে দিয়ে যদি কথা বলা হয়, ভালো। আর যদি কথা না বলে, তাহলে বাইরের রাস্তা আমাদের। আমরা যা করার করব। এখানে সুস্থভাবে কাজ করতে দেব না।” তবে ভবিষ্যতে কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হবে, সে বিষয়ে তিনি নির্দিষ্ট করে কিছু জানাননি।
পররাষ্ট্রনীতি যে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার—এ কথা স্বীকার করলেও শুভেন্দু অধিকারী তার ব্যক্তিগত অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, “আমার ব্যক্তিগত মত, সব বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কোনও কিছু এখান থেকে বাংলাদেশে যাবে না—সেই ব্যবস্থা করা উচিত।” তার এই বক্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
এ সময় তিনি আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানান। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলেছেন। শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “আমি হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করি। সীমান্তবর্তী রাজ্য হিসেবে আমরা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো বুঝি।” তার মতে, সীমান্ত রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় কঠোর অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন।
শুভেন্দুর এই বক্তব্যের বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তৃণমূল অভিযোগ করে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কার্যত নিশ্চুপ রয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর—এদের কেউই বাংলাদেশে দীপু দাস হত্যাকাণ্ড বা সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দেননি। দলটির মতে, এত বড় একটি ইস্যুতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ।
একই পোস্টে তৃণমূল জানায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাষ্ট্রনেতার মতো দায়িত্বশীল আচরণ করে কেন্দ্রকে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফেরাতে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের আহ্বানও জানিয়েছেন বলে দাবি করে দলটি।
তৃণমূল কংগ্রেস কটাক্ষ করে আরও লেখে, “যে প্রধানমন্ত্রী সব সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়, তিনি দীপু দাস হত্যাকাণ্ডে চুপ কেন? মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণেই কি এই নীরবতা?” এই মন্তব্য নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্ক উসকে দিয়েছে।
পাশাপাশি তৃণমূলের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দিতেই বিজেপি নেতারা বাংলাদেশ ইস্যুকে ব্যবহার করছেন। দলটি স্মরণ করিয়ে দেয়, কয়েক মাস আগেই শুভেন্দু অধিকারী প্রকাশ্যে ইউনূস সরকারের প্রশংসা করেছিলেন, যা তার বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ইস্যু এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। একদিকে বিজেপি এটিকে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন হিসেবে তুলে ধরছে, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগ আনছে।
Leave a comment