দেশে যেকোনো উৎসব শুরুর আগে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকার কারবারিরা। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তবে এরই মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এসব কারবারির বিরুদ্ধে থানা পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অভিযান শুরু হয়েছে।অব্যাহত রয়েছে অনলাইন নজরদারিও।
গ্রেফতার হলেও সহজেই জামিন লাভ করায় পুনরায় একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে জাল টাকার কারবারিরা। আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারও সক্রিয় হয়ে ওঠার আভাস দিচ্ছে জাল টাকার কারবারিরা। অনলাইনেও সক্রিয় হয়ে উঠছে চক্রের সদস্যরা।
গত বুধবার বিপুল পরিমাণ জাল নোট ও জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামসহ সংঘবদ্ধ চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন – মো. সাইফুল ইসলাম (২৮), মো. রেজাউল করিম ওরফে রেজা (৪৩), মো. সোহেল (৪০), মো. সাইদুর রহমান (২৮), সোহেল মাহমুদ (২৪) ও মো. শাহ আলম।
এ সময় তাদের হেফাজত থেকে ৮২ হাজার ৩০০ টাকা মূল্যমানের জাল নোট, জাল নোট বিক্রয়লব্ধ নগদ ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা ও জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
ডিবির-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত মঙ্গলবার সকালে সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে যে, বনানী থানার মহাখালী পুলিশ বক্সের সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তিনজন ব্যক্তি জাল নোট ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য অবস্থান করছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে সকালে সেখানে অভিযান চালায় ডিবির টিম। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা কৌশলে পালানোর চেষ্টাকালে ডিবির টিম, মো. সাইফুল ইসলাম ও রেজাউল করিম ওরফে রেজাকে গ্রেফতার করে।
এ সময় তাদের কাছ থেকে চার হাজার টাকা মূল্যমানের জাল নোট উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার পঞ্চগড় সদর থানার ব্যারিস্টার বাজার এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মো. সাইদুর রহমান ওরফে সবুজ, মো. সোহেল মাহামুদ, মো. সোহেল ও মো. শাহ আলমকে গ্রেফতার করা হয়। সবুজ ও সোহেল মাহামুদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক তাদের বাড়িতে তল্লাশি করে ৭৮ হাজার ৩০০ টাকা মূল্যমানের জাল নোট, জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম ও জাল নোট বিক্রির নগদ ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
ডিবি সূত্রে আরও জানা যায়, দীর্ঘ দিন ধরে জাল নোট তৈরি করে আসামিরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করছিল। তারা আসন্ন কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি ও সরবরাহের পরিকল্পনা করছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
অন্যদিকে ফেসবুকেও রয়েছে জাল টাকা বিক্রির অনেক পেজ। ওইসব পেজে একদিকে যেমন হোম ডেলিভারির অফার দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে অগ্রিম টাকা দিয়ে জাল টাকা পাননি এমন মন্তব্যও রয়েছে। আবার জাল টাকা পেতে মরিয়া এ রকম অনেকে খুঁজে ফিরছেন জাল টাকার কারবারিদের। তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, তারা অনলাইনে নজরদারি অব্যাহত রেখেছেন।
‘সময়ের আলোর’ অনুসন্ধানে অনলাইনে জাল টাকা বিক্রির কিছু পেইজের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হচ্ছে- ‘এগ্রেট জাল নোট পাইকারি’, ‘জাল টাকা বিক্রি ডিলার’, ‘টাকার শহর’, ‘জাল টাকার গ্রুপ’, ‘জাল নোট বিক্রি করি’, ‘জাল টাকা বিক্রয় প্রতিনিধি’, ‘জাল টাকা বিক্রি’।
এসব বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান সময়ের আলোর বরাতে বলেন, জাল টাকার বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে বা মামলা হলে তখন সিআইডি এ বিষয়ে তদন্ত করে। এ ছাড়া ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিষয়ে সিআইডির অনলাইন মনিটর টিম সর্বদা সক্রিয় থাকে।
তবে জাল টাকার কারবারিরা প্রায়ই ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলে সহজেই পার পেয়ে যায়। আদালত সূত্রে জানা যায়, জাল টাকা তৈরি করে সরবরাহ ও বাজারজাতকরণে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় প্রায় দুই যুগে (২০০১ থেকে ২০২৪) ৭ হাজারেরও বেশি মামলা রয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশ আসামিই এখন জামিনে মুক্ত। আইনের ফাঁকফোঁকড় দিয়ে বেরিয়ে নব উদ্যমে তারা লেগে যায় টাকা জালিয়াতিতে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইনি দুর্বলতার কারণে জাল কারবারিদের শাস্তির নজির কম। পুলিশ গ্রেফতার করার কয়েক দিনের মধ্যে বেশিরভাগই ছাড়া পেয়ে যায়। এর প্রধান কারণ জাল নোট বিষয়ে আলাদা কোনো আইন নেই।
বর্তমানে দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪৮৯(ক)-(ঘ) ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ এর ২৫(ক) ধারা অনুযায়ী জাল নোটের কারবারির বিচার হয়। এ আইনে কারও বিরুদ্ধে শাস্তি দিতে গেলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হাজির করতে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়রানির ভয়ে সাক্ষী পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে আদালতকেন্দ্রিক একটি সূত্র জানায়, জাল টাকা তৈরি চক্রের নিজস্ব কিছু আইনজীবী রয়েছেন। চক্রের সদস্যরা ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আসামি পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে কোনো কোনো পাবলিক প্রসিকিউটরেরও রয়েছে ঘনিষ্ঠতা। তারা পরস্পরের যোগসাজশে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জালিয়াত চক্রের সদস্যদের চুক্তিতে কারামুক্ত করেন।
সময়ের আলোর বরাতে সিনিয়র আইনজীবী মঞ্জুর আলম বলেন, আইনের প্রয়োগ ও বিচার যদি দ্রুত করা যায় তা হলে জাল নোটের মামলার শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বিচারের সময়সীমা মানা হয় না। সাক্ষীও পাওয়া যায় না। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, আমার কাছে জাল নোটের এমন মামলাও আছে যা ৩০ বছর ধরে ঝুলছে।
তথ্যসূত্র: সময়ের আলো
Leave a comment