ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশের কারণে ১৯টি ভাইরাসের মধ্যে ১১টির প্রকোপ শুধুমাত্র রাজধানীতে দেখা দিয়েছে। ২০২৪ সালে দেশের বিভিন্ন জেলায় মোট ৩০টি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলেও ঢাকার ভাইরাস সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি ছিল।
রোগের প্রকোপের বার্ষিক প্রতিবেদন
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, মেনিনজাইটিসসহ বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরে জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভেজাল খাদ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভাইরাসগুলো দ্রুত ছড়ায়।
মৌসুমী রোগ ও নতুন ভাইরাসের হুমকি
২০২৪ সালে ডেঙ্গু ভাইরাসকে বার্ষিক প্রাদুর্ভাবের তালিকায় ধরা না হলেও এটি সারা বছর জুড়েই সংক্রমণ ও মৃত্যুর কারণ হয়ে ছিল। একই সঙ্গে নতুন ভাইরাস হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়ালেও বাংলাদেশ এখনো সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, “ঢাকায় ভাইরাসের প্রকোপ বেশি হওয়ার প্রধান কারণ জনসংখ্যার ঘনত্ব। মানুষ একে অপরের কাছাকাছি থাকার ফলে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশ এবং এডিস মশার বিস্তার অন্যান্য রোগের প্রকোপ বাড়িয়েছে।”
ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি
রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও রংপুরেও কিছু এলাকায় ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। বিশেষ করে জিকা ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাস পুনরায় সক্রিয় হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রথম শনাক্ত হওয়া জিকা ভাইরাস এক দশক পর আবার ফিরে এসেছে।
ভাইরাস প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. বেনজীর আহমেদ জানান, “নিম্ন আয়ের মানুষের টিকা গ্রহণের হার কম। বিশেষ করে বস্তি ও ভাসমান জনগোষ্ঠী ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা পেতে বঞ্চিত। এটি ভাইরাসের বিস্তারের অন্যতম কারণ।”
বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, বায়ুদূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন, অপরিকল্পিত জীবনযাত্রা এবং খাদ্যে ভেজালের কারণে ভাইরাসের প্রকোপ আরও বাড়ছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মশা নিধন, এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সংক্রমণ অনেকটাই কমানো সম্ভব।
২০২৪ সালের সর্বাধিক প্রাদুর্ভাবকারী রোগ
আইইডিসিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তড়কা (অ্যানথ্রাক্স) ভাইরাস ছিল বছরের সর্বাধিক প্রাদুর্ভাবকারী। এটি ১৬টি জেলায় ৮ বার সংক্রমণ ঘটিয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল ডায়রিয়া, যা প্রায় ১১ লাখ মানুষকে আক্রান্ত করে এবং ২০০ জনের বেশি মৃত্যুর কারণ হয়।
অন্যান্য ভাইরাসগুলোর মধ্যে চিকেন পক্স, মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, এবং প্যানডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জার নাম উঠে এসেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন ঘুমিয়ে থাকা জীবাণুগুলোকে সক্রিয় করে তুলছে। তাপমাত্রা বাড়ায় ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, এবং অন্যান্য মশাবাহিত রোগের বিস্তার ঘটছে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৩০ সালের পর থেকে প্রতি বছর ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
সরকারি প্রস্তুতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা আরও কঠোর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইইডিসিআরের জিন বিশ্লেষণ কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, “রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে একটি মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
সতর্কতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকায় ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
Leave a comment