জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করে নতুন এক রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছেন। বহু দশক ধরে বৈধভাবে কার্যক্রম চালানো এই সংগঠনটিকে একঝটকায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় প্রেরণা বলে মনে করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে খুশি করা।
দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার সহায়তার ওপর নির্ভরশীল জর্ডান নানা সময়ে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থেকেছে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণার চেষ্টা এবং তাঁর প্রশাসনে এরিক ট্র্যাগারের মতো ঘোরতর ইসলামপন্থা-বিরোধী উপদেষ্টার উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে, এই নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক লাভের অংশ হিসেবেই এসেছে। এর পুরস্কারস্বরূপ ট্রাম্প আমলে বন্ধ হয়ে যাওয়া জর্ডানের গুরুত্বপূর্ণ পানিশোধন প্রকল্পে আবার অর্থসাহায্য চালু হয়েছে।
কিন্তু এই রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য বাদশাহ আবদুল্লাহ যে মূল্য দিচ্ছেন, তা দেশীয় স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মুসলিম ব্রাদারহুড ১৯৪৫ সাল থেকে জর্ডানে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে এবং দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাদশাহ হুসেইনের শাসনামলে এই সংগঠন সরকারের সঙ্গে বহুবার সহযোগিতায় এসেছে। ১৯৯০ সালে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় অভ্যন্তরীণ ঐক্য টিকিয়ে রাখতে হুসেইন ব্রাদারহুড নেতাদের মন্ত্রীত্ব দিয়েছিলেন। এমনকি তারা একাধিকবার সরকারের বিরোধিতা করলেও, হুসেইন তাদের নিষিদ্ধ করেননি।
বর্তমান বাদশাহ আবদুল্লাহ প্রথমে হামাসকে দেশছাড়া করেন, এরপর ব্রাদারহুডের দাতব্য সংস্থা ও রাজনৈতিক শাখা ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্টের কার্যক্রমে বাধা দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সংগঠন তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্ট ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৩১টি জয় করে, যা তাদের শক্তিশালী উপস্থিতির প্রমাণ।
এই নিষেধাজ্ঞা শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই অস্থিতিশীল করে তুলছে না, বরং জর্ডানের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকেও বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ব্রাদারহুড ও হামাসের মধ্যে পূর্ববর্তী সমঝোতা ভেঙে যাওয়ায় এখন জর্ডান থেকে ইসরায়েল অভিমুখে হামলা চালানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা বড় আকারের সংঘাত ডেকে আনতে পারে।
অন্যদিকে, জর্ডানের গোয়েন্দা সংস্থা—যা ব্রিটিশ ও পরবর্তীতে সিআইএ-এর প্রভাবে গঠিত—এখন ব্রাদারহুডবিরোধী দমননীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগের ছত্রছায়ায় ব্রাদারহুডকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে মিডিয়ায়, যেখানে বলা হচ্ছে তারা জনগণকে উসকানি দিচ্ছে ইসরায়েলি দূতাবাস ঘেরাও করতে। বাস্তবে, জর্ডানের মতো দেশে মিডিয়ার এ ধরনের অভিযান সরাসরি গোয়েন্দা নির্দেশেই চলে।
এই প্রেক্ষাপটে বাদশাহ আবদুল্লাহ যেন নিজের সুরক্ষা বলয় নিজেই সরিয়ে দিচ্ছেন। ব্রাদারহুড ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্তির এক প্রকার ‘সেফটি ভাল্ব’, যা সমাজের ভেতরের চাপ প্রশমনে কার্যকর ছিল। সেটিকে নিষিদ্ধ করে তিনি সমাজের ক্ষোভ আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন।
উল্লেখযোগ্য যে, জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদে সম্প্রতি ইসরায়েলি উগ্রবাদীদের আগ্রাসী তৎপরতা বাড়লেও বাদশাহ এর কোনো দৃশ্যমান প্রতিবাদ জানাননি। উল্টো, ওই ঘটনার প্রতিবাদে দেশজুড়ে ক্ষোভ বাড়তেই তিনি ইসলামপন্থীদের দমন শুরু করেছেন।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইসরায়েলের চোখে বাদশাহ এখন আর আগের মতো আত্মবিশ্বাসী নেতা নন। বরং তাঁকে দেখা হচ্ছে এমন একজন হিসেবে যাকে চাপ দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো চালানো যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাদশাহ আবদুল্লাহ যদি এখনো সময় থাকতে ভুল স্বীকার না করেন এবং জনগণের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন না করেন, তাহলে ইতিহাস তাঁকে একটি ব্যর্থ নেতার আসনে বসাবে। একইসঙ্গে হাশেমি রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে।
Leave a comment