ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র হামলার পর ৭ মে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জের ধরে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত শুরু হলে ভারতের মূলধারার একাধিক সংবাদমাধ্যম এমন সব খবর প্রচার করে, যা পরে ভুল বা ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়।
এই প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস ১৭ মে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে তুলে ধরে, কীভাবে ভারতের শীর্ষস্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদমাধ্যম যাচাই-বাছাই না করে নাটকীয় ও উগ্র জাতীয়তাবাদী খবর পরিবেশন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। এ প্রতিবেদনের লেখকরা—অনপ্রীতা দাস ও প্রগতি কে বি—নয়াদিল্লি থেকে ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সংঘাতকালীন সময়ে সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমের দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা কীভাবে ভারতের গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সংঘাত শুরুর পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয় যে, পাকিস্তানের একটি পারমাণবিক ঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে, দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে এবং করাচি বন্দরে সফল হামলা চালানো হয়েছে। এসব খবর ছিল অত্যন্ত নির্দিষ্ট ও নাটকীয়, কিন্তু কোনও স্বতন্ত্র উৎস বা উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই সেগুলো সম্প্রচার করা হয়। অল্টনিউজ নামক ভারতের নিরপেক্ষ ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা পরে এসব তথ্য যাচাই করে দেখায় যে সেগুলো ছিল সম্পূর্ণ ভুয়া।
এই ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই নয়, বরং প্রধানধারার গণমাধ্যমও জড়িত ছিল। অল্টনিউজের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জনপ্রিয় চ্যানেল আজতক ও নিউজ১৮–এর মতো প্রতিষ্ঠান সরাসরি ভুয়া খবর প্রচার করেছে। এমনকি কিছু টিভি চ্যানেলে মানচিত্র দেখিয়ে দাবি করা হয়, ঠিক কোথায় পাকিস্তানে হামলা চালানো হয়েছে। অথচ পরবর্তীতে জানা যায়, সেসব জায়গায় বাস্তবে কোনও সামরিক অভিযানই হয়নি।
সংঘাতকালে প্রচারিত একটি ভাইরাল ভিডিওতে করাচির আকাশে কালো ধোঁয়া দেখা যায়, যা করাচি বন্দরে হামলার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। পরে ফ্যাক্টচেক করে দেখা যায়, সেই দৃশ্য আসলে ছিল ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলার ছবি। ভারতের নৌবাহিনী পরবর্তী ব্রিফিংয়ে স্পষ্ট জানায়, তারা করাচিতে হামলার প্রস্তুতি নিলেও বাস্তবে কোনও অভিযান চালায়নি।
এ বিষয়ে কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড্যানিয়েল সিলভারম্যান বলেন, ভুল তথ্য সাধারণত উত্তেজনা, আবেগ ও শত্রুতা উসকে দিতে ছড়ানো হয়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান বৈরিতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে এসব ভুয়া খবর সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের কাছে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো—যেসব গণমাধ্যম এতদিন নিরপেক্ষ ও পেশাদার সংবাদ পরিবেশনের জন্য পরিচিত ছিল, তারাও এবার ভুয়া তথ্যের ধারক-বাহক হয়ে ওঠে। আমেরিকান ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক সুমিত্রা বদ্রিনাথন বলেন, এর আগে ভুল তথ্য ছড়ানো হতো বট অ্যাকাউন্ট বা অনির্ভরযোগ্য উৎস থেকে। কিন্তু এবারের পার্থক্য হলো, অনেক পরিচিত ও বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিকরাও যাচাই না করে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করেছেন।
ইন্ডিয়া টুডের খ্যাতনামা সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই এ ঘটনায় প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার খবরটি আমরা যাচাই না করেই সম্প্রচার করেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, এটা ছিল একটা বড় ভুল।’ নিজের ইউটিউব ব্লগে তিনি আবারও ক্ষমা চেয়ে বলেন, অনেক ভুয়া খবর একটি পরিকল্পিত প্রচারাভিযানের অংশ ছিল, যা ‘জাতীয় স্বার্থের’ আড়ালে উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর ভুয়া প্রচারে পরিণত হয়েছিল।
ভারতের সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানায়, দেশটির প্রায় ২০ কোটি পরিবারে টেলিভিশনের উপস্থিতি গণমাধ্যমকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছে। অথচ টেলিভিশনের এই শক্তি যদি যাচাইহীন, উগ্র ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়াতে ব্যবহৃত হয়, তা দেশের গণতন্ত্র ও তথ্যস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
অল্টনিউজের প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বলেন, আজকের ভারতে তথ্যপ্রবাহের অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। ভুয়া খবর ঠেকাতে ফ্যাক্টচেকিং ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রয়োজন এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তবে সত্য প্রকাশের এই লড়াই সহজ নয়—কারণ অল্টনিউজকে একাধিক মামলার মুখে পড়তে হয়েছে, তাদের সাংবাদিকরাও নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
যুদ্ধ ও সংঘাতকালে জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে অনেক সময় সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয়—তবে তা যেন সত্যকে আড়াল করার অজুহাতে পরিণত না হয়। ভারতের গণমাধ্যমে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভুল তথ্য প্রচারের ঘটনা শুধু সাংবাদিকতার নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের তথ্যনৈতিক নৈতিকতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
Leave a comment