বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা—২০০৯ সালের পিলখানা বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন নতুন গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর তথ্য তুলে ধরেছে। কমিশনের দাবি, ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত এবং এতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। মূল সমন্বয়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন তৎকালীন সংসদ সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।
রোববার (৩০ নভেম্বর) কমিশন প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তুলে দেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত আনুষ্ঠানিক বৈঠকে কমিশনের অন্যান্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবেদন গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতির বহু প্রশ্ন ছিল। আপনারা সত্য উদ্ঘাটনে যে ভূমিকা রেখেছেন, জাতি তা স্মরণ রাখবে।”
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে এই প্রতিবেদন বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দীর্ঘদিনের বিভ্রান্তি ও অজানা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটাবে।
কমিশন প্রধান ফজলুর রহমান জানান, ১৬ বছর আগের ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে বেশ কিছু গুরুতর প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। যেমন—বহু গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস হয়ে গেছে, প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট অনেকেই বিদেশে চলে গেছেন,সরকারি নথির কিছু অংশ অসম্পূর্ণ। তবুও কমিশন সাক্ষীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করে, আগের তদন্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য যাচাই করে একটি সুসংহত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।
তিনি বলেন,“বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনমনে থাকা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।”
কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার প্রতিবেদনের মূল অনুসন্ধানগুলো তুলে ধরে বলেন— হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত, এই পরিকল্পনায় প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন শেখ ফজলে নূর তাপস ,তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল বলে কমিশনের দাবি , আওয়ামী লীগ ঘটনাটি আড়াল ও অভিযুক্তদের রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিলো
তিনি উল্লেখ করেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের দিন ২০–২৫ জনের একটি স্থানীয় আওয়ামী লীগ–সমর্থিত মিছিল পিলখানায় প্রবেশ করে এবং বের হওয়ার সময় সেই মিছিলে মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই শতাধিক—যা “অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক”।
কমিশনের পর্যবেক্ষণে সেনাবাহিনী কেন দ্রুত অ্যাকশন নেয়নি, পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার গুরুতর ব্যর্থতা, কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার “অপেশাদার আচরণ” এসব বিষয়গুলো উঠে এসেছে
কমিউনিকেশন, নিরাপত্তা–প্রটোকল ও তথ্য ব্যবস্থাপনায় “অসাধারণ বিশৃঙ্খলা” ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কমিশন জানায়, ঘটনার সময় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব বিডিআর সদস্যের সাথে বৈঠক করেন, তাদের নাম-পরিচয়, দায়িত্ব বা তথ্য সঠিকভাবে নথিবদ্ধ করা হয়নি—যা পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা কাঠামোর অন্যতম বড় ঘটনা—বিডিআর হত্যাকাণ্ড—নিয়ে নতুন এই প্রতিবেদন দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে। কমিশনের দাবি অনুযায়ী রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হলে এটি হবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অপরাধের একটি। এখন সবার চোখ সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে—প্রতিবেদনটি কি বিচার প্রক্রিয়ার নতুন অধ্যায় শুরু করবে, নাকি বিতর্ক আরও ঘনীভূত হবে?
Leave a comment