Home ইতিহাসের পাতা বাংলা ভাষা: ইতিহাস, বিস্তার ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক
ইতিহাসের পাতা

বাংলা ভাষা: ইতিহাস, বিস্তার ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক

Share
Share

বাংলা ভাষা, যাকে বাঙলা, বাঙ্গলা কিংবা বাঙ্গালা নামেও অভিহিত করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার এক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত ধ্রুপদী একটি ভাষা, যার জন্ম বহু শতাব্দী আগের প্রাকৃত এবং অপভ্রংশ রূপ থেকে। আজ এটি প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এবং বিশ্বের সপ্তম সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলা ভাষার মূল বিস্তার বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকা অঞ্চলজুড়ে। এছাড়াও ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, মেঘালয় ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জসহ বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। এমনকি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার অভিবাসী সমাজেও বাংলাভাষার অস্তিত্ব দৃঢ়ভাবে অনুভূত হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পর্যন্ত সবকিছুই বাংলায় সম্পন্ন হয়। ভারতের জাতীয় সংগীত ‘জন গণ মন’ এবং স্তোত্র ‘বন্দে মাতরম’-এর উৎসও বাংলা ভাষায় নিহিত। ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর, ভারত সরকার বাংলা ভাষাকে “ধ্রুপদী ভাষা” হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে, যা এই ভাষার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সাহিত্যিক ঐশ্বর্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে ধরা যায়।

বাংলা ভাষার শিকড় প্রাচীন মাগধী প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত অপভ্রংশ ও অবহট্‌ঠ ভাষায়। ভাষার লিখিত ইতিহাস শুরু হয় চর্যাপদ থেকে, যা ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত ধ্রুপদী বৌদ্ধ ধর্মীয় পদাবলি। এরপর চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি প্রমুখ কবিদের মাধ্যমে মধ্য বাংলা যুগে সাহিত্যিক ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের পর শুরু হয় আধুনিক বাংলা যুগ, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকগণ বাংলাকে একটি বিশ্বজনীন সাহিত্যভাষায় রূপান্তরিত করেন।

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে রয়েছে প্রায় ৭৫,০০০ শব্দ। এদের মধ্যে ৬৭% তৎসম, ২৮% তদ্ভব এবং প্রায় ৫,০০০ বিদেশি শব্দ (যেমন আরবি, ফারসি, ইংরেজি)। এই ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দচয়নের নির্মাণে যেমন সংস্কৃত ও পালি ভাষার প্রভাব রয়েছে, তেমনি আছে মধ্যযুগীয় ফারসি প্রশাসনিক ব্যবস্থার ছোঁয়া।

বাংলা ভাষা কেবল একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতীক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, যেখানে বাঙালি তরুণরা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে জীবন উৎসর্গ করেন, তারই প্রমাণ। এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

বাংলা ভাষার গৌরবময় এই অভিযাত্রা কেবল অতীত স্মৃতিচারণ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন। বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলার সাহিত্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও মিডিয়া বিকাশের মাধ্যমে বাংলার অবস্থান ক্রমেই সুদৃঢ় হয়ে উঠছে।

 

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

পুরোনো বিমানবন্দরে ‘এয়ার শো’ দেখতে মানুষের ঢল

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে আয়োজিত বিশেষ ‘এয়ার শো’ দেখতে মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই মানুষের ঢল নেমেছে। উৎসবমুখর পরিবেশে...

বিজয় দিবসকে ঘিরে দেশজুড়ে র‌্যাবের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রস্তুতি

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সারাদেশে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, জনসমাগমস্থল এবং বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত...

Related Articles

ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা

আজ বৃহস্পতিবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ইং। ৩ পৌষ, ১৪৩২ বাংলা। ২৬ জমাদিউস...

ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা

আজ বুধবার ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ ইং। ২ পৌষ, ১৪৩২ বাংলা। ২৫ জমাদিউস...

ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা

আজ সোমবার ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ ইং। ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বাংলা। ২৩ জমাদিউস...

ইতিহাসের আজকের দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা

আজ বৃহস্পতিবার ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ইং। ২৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বাংলা। ১৯ জমাদিউস...