ইসরাইলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। কারা, কেন এভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে ,তাদের উদ্দেশ্যই বা কি ছিল?
সোমবার এসব ঘটনার পরপরই তৎপর হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রথম আলোর বরাতে জানা গেছে , গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৫৬ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে- দেশে বিনিয়োগ সম্মেলন চলার সময় এভাবে বিদেশি মালিকানা প্রতিষ্ঠানে হামলা-লুটপাটে কারও উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ ছাড়া চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুযোগ নেয়ার লক্ষ্যেও কোনো পক্ষ এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।
সিলেটে এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পেছনে কারা রয়েছে ?
সিলেটে রাতভর অভিযান চালিয়ে পুলিশ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ বলছে; ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তারা সবাই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। শুধু এই ১৪ জনই নয় আরও অনেককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে। ঘটনায় ক্ষুব্ধ মানুষ। শুধু যে কেএফসি কিংবা বাটাতে হামলা ভাঙচুর হয়েছে তা নয়। রেস্টুরেন্ট, মিষ্টির দোকান, ফার্মেসিসহ নানা পণ্যের দোকানে হামলা ও লুটপাট হয়েছে।
সেনা সদস্যরা মাঠে নামায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সিলেটে। বন্দরের বাটা জুতার দোকানে লুট করতে ভেতরে ছিল ১৫-২০ জন যুবক। সব ঘটনারই ভিডিও ছবি আছে। এজন্য আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে পুলিশের জন্য সহজ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার ওসি মো. জিয়াউল হক।
কেউ কেউ আবার লুটের ছবি নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দেন। উল্লাসের দৃশ্য দেখান।যারা পোস্ট দিয়েছেন তাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সিলেট নগর বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদীসহ মহানগর নেতারা বিকালে ট্রাক নিয়ে নগরে নামেন। যেখানেই লুটপাটের দৃশ্য দেখেছেন সেগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কয়েস লোদী মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে বিকালে সিলেট বিএনপি’র তরফ থেকে মিছিল বের করা হয়। এ মিছিলটি আম্বরখানা এলাকায় গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে শেষ হয়ে নেতাকর্মীরা যার যার বাড়ি চলে যান। এই সময় খবর আসে ভাঙচুরের। প্রথমে আমরা শুনতে পারি হাউজিং এস্টেট, আম্বরখানা এলাকায় ভাঙচুর হচ্ছে।
এ খবর পেয়ে আমিসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করি। এরপর আরও কয়েকটি স্থানে ভাঙচুরের খবর পাই।
সাবেক মেয়র আরিফ ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে বলেন- যারা ভাঙচুর করছে তারা দুর্বৃত্ত। সম্মিলিতভাবে সবাইকে এক হয়ে ওদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে। না হলে সিলেটের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
কেউ কেউ বলছেন; পরাজিত শক্তিরা প্রতিবাদ কর্মসূচির আড়ালে সিলেটকে অশান্ত করতে এই ভাঙচুর করেছে। তারা বিভিন্ন গ্রুপের ভাগ হয়ে এ মিশনে অংশ নেয়। সেনা সদস্যরা মাঠে নামার পর তারা চলে যায়। এদিকে- নগরীর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক রাতে নগরব্যাপী ট্রাকযোগে মাইক নিয়ে সচেনতার লক্ষ্যে নগর বিএনপি’র পক্ষ থেকে প্রদক্ষিণ করা হয়।
সিলেটে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরা হলো- কাজীটুলা এলাকার মো. রাজা মিয়ার ছেলে মো. রাজন, একই এলাকার আরব আলীর ছেলে ইমন, দীন ইসলামের ছেলে মো. রাকিব, লাল সাদ আহমদের ছেলে মিজান আহমদ, সওদাগরটুলা এলাকার মৃত আবুল বাশার মিয়ার ছেলে মো. আব্দুল মোতালেব, গোয়াইটুলা এলাকার লিয়াকত আলীর ছেলে সাব্বির আহমদ, কোম্পানীগঞ্জের ফরিদ মিয়ার ছেলে জুনাইদ আহমদ, মিরের ময়দান এলাকার মৃত মোস্তফা মিয়ার ছেলে মো. রবিন মিয়া, শাহী ঈদগাহ এলাকার মো. মহছন আহমদের ছেলে মোস্তাকিন আহমদ তুহিন, দরগাহ গেইট এলাকার আব্দুল ছাত্তারের ছেলে মো. দেলোয়ার হোসেন, শেখঘাট এলাকার শামীম আহমদের ছেলে মো. রিয়াদ, বালুচর নতুন বাজার এলাকার দুলাল মিয়ার ছেলে মো. তুহিন, বটেশ্বর বাজারের সেলিম রেজার ছেলে আল নাফিউ এবং নোয়াখালীর চাদমিল থানার পশ্চিম নাহার কিল গ্রামের সৈয়দ আলতাফ মানিকের ছেলে সৈয়দ আল আমিন তুষার।
খুলনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা হামলাকারীদের নিয়ে যা বললেন :
খুলনার শিববাড়ি মোড়ে হোটেল টাইগার গার্ডেনে অবস্থিত বাটা শোরুম ও ময়লাপোতা মোড় এলাকায় কেএফসিতে বিক্ষুব্ধ জনতা ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে। বর্তমানের শোরুমটি ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ঘটনার পর পুলিশ, র?্যাব এবং যৌথ বাহিনী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
এ ঘটনায় সিসি ফুটেজ দেখে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অন্তর নামে বাটার একজন কর্মচারী বলেন, মাগরিবের নামাজের পর দেড়শ’ থেকে দুইশ’ বিক্ষুব্ধ জনতা শোরুমের ভেতর ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। এ সময় শোরুমের ম্যানেজার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বাধা দিতে গেলে তাকে মারধর করে আহত করা হয়। এ ছাড়া একজন নিরাপত্তাকর্মীও আহত হয়েছেন। হামলাকারীদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা টোকাই শ্রেণির লোক আবার কিছু লুটপাটকারী ঘাট এলাকার শ্রমিক মনে হচ্ছিল।
তিনি বলেন, হামলাকারীরা এ সময় শোরুমের ৮০ শতাংশ মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায় যার আনুমানিক মূল্য ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। একইভাবে অভিজাত রেস্টুরেন্ট কেএফসি ভাঙচুর লুটপাট করার সময় খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতে দেখা যায়।এ খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসলে হামলাকারীরা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) আহসান হাবীব বলেন, ভাঙচুর ও লুটপাট হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে রাতভর অভিযান চালিয়ে ৩১ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজারে তৌহিদ জনতার ব্যানারের আড়ালেই কি ছিল লুটপাট এর উদ্দেশ্য ?
‘তৌহিদি জনতার ব্যানারে’ মূলত এই বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী ও সমন্বয়কদের একটি অংশ। কিন্তু তাদের মিছিল থেকেই এ ধরনের ভাঙচুরের ঘটনা রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক সচেতন মহল।
কক্সবাজার সদর রামু আসনের সাবেক এমপি লুৎফুর রহমান কাজল তার ফেসবুক ওয়ালে প্রশ্ন তুলে লিখেছেন, “ফিলিস্তিনের পক্ষে অহিংস কর্মসূচি পালন করুন। ঢাকায় বহুজাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন হচ্ছে। বিনিয়োগ ব্যাহত হওয়ার জন্য, ভাঙচুর লুটপাটেরউস্কানিতে ষড়যন্ত্রকারীরা জড়িত আছে কিনা?
আরেক ব্যবসায়ী নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মিছিলের নেতৃত্বে ছিল শিবির ও তাদের অনুসারী সমন্বয়ক নেতারা। আগে পিছে পুলিশও ছিল। বাইর থেকে কেউ মিছিলে ঢুকে ভাঙচুর করার সুযোগ নেই। হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাটি পরিকল্পিত এবং তা মিছিলে অংশগ্রহণকারীরাই করেছে।
এদিকে কক্সবাজার শহরে ৫টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় ১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। ছবি দেখে শনাক্ত করে তাকে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আটক ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ হাসিম। তিনি সদরের ভারুয়াখালীর বাইন্না পাড়ার বাসিন্দা।
কক্সবাজার জেলা রেস্তরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাবেদ ইকবাল জানিয়েছেন, ইসরাইলি পণ্য রাখার অভিযোগে বিক্ষোভ মিছিল থেকে কিছু উশৃঙ্খল লোকজন কেএফসি, পিজ্জা হাট, কাঁচা লঙ্কা, পানশি রেস্টুরেন্ট, মেরিন ফুড রেস্টুরেন্টে ভাঙচুর চালিয়েছে। তার মতে, বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিলে কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে পড়ে এবং তারা পরিকল্পিতভাবে ভাঙচুর চালিয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা-ই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
বরিশালেও কেএফসিতে ভাঙচুর হামলা চালায় মিছিলের একটি অংশ :
বরিশালে কেএফসিতে ভাঙচুর নিয়ে কোনো গ্রেপ্তার নেই। স্থানীয়রা জানিয়েছেন কেএফসিতে হামলার আগে সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন নামাজ পড়েছেন। এর পরপরই হামলার ঘটনা ঘটে।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে সোমবার বরিশালে গ্লোবাল স্ট্রাইক ফর গাজা কর্মসূচি পালনকালে বগুড়া রোডস্থ কেএফসিতে হামলার ঘটনাটি ঘটে। ছাত্র জনতার ব্যানারে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও সড়কে নামাজ আদায়সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে দিনভর কর্মসূচি পালন করেন। এসময় বিক্ষুব্ধরা ইসরাইলকে অর্থ সহায়তা দেয়ার অভিযোগে কেএফসির বরিশাল ব্রাঞ্চে ভাঙচুর চালান।তারা কেএফসির দেয়ালে ‘বয়কট কেএফসি’ লিখে দেয়। এরপর সড়কে দাঁড়িয়েই নামাজ আদায় করে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন।
গাজীপুরে বাটা শোরুমসহ হোটেল ভাঙচুরের অভিযোগে গ্রেপ্তার ৪:
গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় ইসরাইলের বর্বরতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলের সময় পূর্ব পূর্বপরিকল্পিতভাবে তৃপ্তি হোটেল, রাধুনী হোটেল এবং বাটা কোম্পানি ডিলারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নাশকতা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, সিয়াম খান (অনিক), শিমুল আহাম্মেদ শাওন, শাহীন ও জয়নাল আবেদীন। এ ব্যাপারে গাছা থানায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান সহকারী উপ-কমিশনার হাফিজুল ইসলাম।
ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গাছা থানার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। পরে থানা পুলিশ এবং সেনাবাহিনী সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ ব্যাপারে গাছা থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
Leave a comment