ধরা যাক, একটি মুহূর্ত, একটি গান বা একটি কণ্ঠস্বর চিরকাল ধরে রাখা সম্ভব। আজকের ডিজিটাল যুগে এটি খুবই স্বাভাবিক শোনালেও, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এটি ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। টমাস আলভা এডিসনের হাত ধরে ১৮৭৭ সালে জন্ম নেয় ফনোগ্রাফ, যা ছিল শব্দ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের প্রথম বাস্তবসম্মত মাধ্যম।
১৮৭৭ সালে এডিসন যখন প্রথমবারের মতো শব্দ রেকর্ড করে সেটি পুনরায় শোনান, বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। প্রথমদিকে মোমের রোল বা সিলিন্ডার ব্যবহার করা হলেও পরে ভিনাইল ডিস্ক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গ্রামোফোন ডিস্ক ও রেকর্ড প্লেয়ারের উন্নতি ফনোগ্রাফের জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে তোলে।
ফনোগ্রাফের আবির্ভাবের আগে সংগীত ও কণ্ঠ সংরক্ষণের কোনো উপায় ছিল না। শুধুমাত্র সরাসরি পারফরম্যান্সের ওপরই নির্ভর করতে হতো। কিন্তু ফনোগ্রাফের মাধ্যমে সংগীতশিল্পীরা তাঁদের গান রেকর্ড করে দূর-দূরান্তের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। ফলে সংগীতশিল্পীদের নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয় এবং রেকর্ডিং ইন্ডাস্ট্রির যাত্রা শুরু হয়।
১৯২০ ও ৩০-এর দশকে যখন বেতার সম্প্রচার জনপ্রিয়তা পায়, তখনও ফনোগ্রাফের গুরুত্ব কমেনি। বরং এটি বেতারের সঙ্গে একযোগে সংগীতশিল্পী ও শ্রোতাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে ভূমিকা রেখেছে।
ফনোগ্রাফ থেকে শুরু করে আজকের ডিজিটাল মিউজিক পর্যন্ত পথচলা ছিল দীর্ঘ। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে ভিনাইল রেকর্ডের স্বর্ণযুগ আসে, যা সংগীতপ্রেমীদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয়। এরপর ক্যাসেট টেপ, সিডি, এমপি৩ এবং বর্তমানে স্ট্রিমিং সেবার মাধ্যমে সংগীত শোনার ধরন একেবারে পাল্টে গেছে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, পুরনো প্রযুক্তিগুলো সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়নি। বর্তমানে অনেক সংগীতপ্রেমী এবং ডিজে ভিনাইল রেকর্ড ব্যবহার করেন, যা ক্লাসিক সাউন্ড কুয়ালিটির জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত।
ফনোগ্রাফ শুধু একটি যান্ত্রিক উদ্ভাবন নয়; এটি মানব সভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি আমাদের শব্দ সংরক্ষণের ধারা পরিবর্তন করেছে, সংগীতশিল্পী ও শ্রোতাদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়েছে এবং আধুনিক অডিও প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছে।
ফনোগ্রাফের হাত ধরেই আজ আমরা ডিজিটাল যুগের সংগীত উপভোগ করছি। এডিসনের এই আবিষ্কার আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, শব্দেরও এক জীবন আছে, যা শতাব্দী পেরিয়েও আমাদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।
Leave a comment