পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় আরও তিনটি নৌযানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হামলায় অন্তত আটজন নিহত হয়েছেন। মার্কিন সাউদার্ন কমান্ড (সাউথকম) জানিয়েছে, সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) পরিচালিত এসব হামলা ছিল “মারাত্মক কাইনেটিক স্ট্রাইক”, যা লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান সামরিক অভিযানের সর্বশেষ ও সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সাউথকম এক বিবৃতিতে জানায়, পৃথক তিনটি নৌযানে চালানো এই অভিযানে প্রথমটিতে তিনজন, দ্বিতীয়টিতে দুইজন এবং তৃতীয়টিতে তিনজন নিহত হন। তবে নিহতদের পরিচয় কিংবা হামলার আগে কোনো সতর্কতা দেওয়া হয়েছিল কি না—সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি মার্কিন সামরিক বাহিনী। কোনো প্রমাণ উপস্থাপন না করেই দাবি করা হয়েছে, নিহতরা মাদক পাচার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এই হামলার নির্দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ দিয়েছেন বলে সাউথকমের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এর ফলে অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ভূমিকা এবং আইনগত বৈধতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক জলসীমায় বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া প্রাণঘাতী হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও সমুদ্র আইন লঙ্ঘনের শামিল হতে পারে।
এই হামলা এমন এক সময়ে ঘটল, যখন গত কয়েক মাসে প্রশান্ত মহাসাগর ও ভেনেজুয়েলার কাছাকাছি ক্যারিবীয় সাগরে মার্কিন সামরিক অভিযানে হতাহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত এসব হামলায় অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার বা বিচারিক প্রক্রিয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
আইন বিশ্লেষকদের একটি অংশ এসব ঘটনাকে সরাসরি ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের যুক্তি, মাদক পাচার দমন একটি বৈধ লক্ষ্য হলেও আন্তর্জাতিক জলসীমায় সামরিক শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, অনুপাতিকতা এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ অপরিহার্য।
মার্কিন কংগ্রেসের কয়েকজন আইনপ্রণেতা প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসে একটি নৌযানে প্রথম হামলার পরও, সেখানে জীবিত থাকা ব্যক্তিরা ধ্বংসাবশেষ আঁকড়ে ধরে থাকার সময় দ্বিতীয় দফা হামলার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত মানবিক আইন ও সামরিক নৈতিকতার পরিপন্থী কি না—সে বিষয়ে তদন্তের দাবি উঠেছে।
তবে পেন্টাগন এসব সমালোচনা নাকচ করে বলছে, মাদক পাচার চক্রগুলো অত্যাধুনিক অস্ত্র ও দ্রুতগতির নৌযান ব্যবহার করছে, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। তাদের দাবি, এসব অভিযান আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করেই পরিচালিত হচ্ছে।
এই অভিযানের পাশাপাশি ক্যারিবীয় অঞ্চল ও মেক্সিকো উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। সেখানে ইতিমধ্যে যুদ্ধজাহাজ, একটি সাবমেরিন, ড্রোন এবং যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, এর মূল উদ্দেশ্য মাদক পাচার রোধ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা।
তবে ভেনেজুয়েলা এ ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির দাবি, মাদক দমনের আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের বিপুল তেল ও গ্যাস সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। গত সপ্তাহে মার্কিন বাহিনী একটি ভেনেজুয়েলার তেলবাহী ট্যাঙ্কার জব্দ করলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। ওই ঘটনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ধরে নিচ্ছি আমরা তেলটি রেখে দেব”—যা কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সাম্প্রতিক হামলাগুলো এমন সময় ঘটছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার আশপাশে নিজেদের কার্যকরী সক্ষমতা আরও জোরদার করছে। সোমবার ত্রিনিদাদ ও টোবাগো ঘোষণা দেয়, আগামী কয়েক সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিমানগুলোকে লজিস্টিক সহায়তার উদ্দেশ্যে—সরবরাহ পুনর্ভরণ ও জনবল রোটেশনের জন্য—তাদের বিমানবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে।
ক্যারিবীয় এই দ্বীপদেশটি ভেনেজুয়েলার উপকূল থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অঞ্চলটির কিছু সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির বিরোধিতা করলেও, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী কামলা পারসাদ-বিসেসার আগে এক বক্তব্যে বলেন, মাদক পাচারকারীরা তার দেশের নাগরিকদের হুমকি দেওয়ার চেয়ে তিনি তাদের “টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দেওয়া” দেখতেই বেশি পছন্দ করবেন।
এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম টেলেসুরের বরাতে জানা গেছে, তিনি ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এতে ক্যারিবীয় অঞ্চলের জ্বালানি নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে।
সব মিলিয়ে, প্রশান্ত মহাসাগরে তিন নৌযানে সাম্প্রতিক এই হামলা শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়; বরং এটি যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকার মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন। মাদক পাচার দমন, জ্বালানি রাজনীতি ও সামরিক প্রভাব বিস্তারের এই জটিল সমীকরণ আগামী দিনে অঞ্চলটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র: সিএনএন, আল-জাজিরা
Leave a comment