সম্প্রীতি পাকিস্তান সরকার দেশটির বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে ‘ফিল্ড মার্শাল পদে’ পদোন্নতি দিয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এই পদমর্যাদা সবচেয়ে উচ্চ এবং বিরল। পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন পদমর্যাদা কেবলমাত্র আইয়ুব খান পেয়েছিলেন। আসিম মুনির এখন পাকিস্তানের দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ উপাধি পেলেন।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক স্বল্পস্থায়ী অথচ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অসাধারণ নেতৃত্ব ও দেশের পক্ষে অবদানের জন্য তাঁকে এই মর্যাদাপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান সরকার মনে করে, এই সংকটময় মুহূর্তে আসিম মুনিরের সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বই দেশকে রক্ষা করেছে। এজন্য তাঁকে ফিল্ড মার্শাল করা হয়েছে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ৬৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাবিনেট তৎকালীন সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে সেই সম্মানজনক পদ দিয়েছিল।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদাটা আসলে কি?
ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা হল – সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ উপাধি। এটি মূলত ব্রিটিশ সামরিক ঐতিহ্য থেকে এসেছে।পুরোনো জার্মান ভাষায় এর অর্থ রাজার ঘোড়ার তত্ত্বাবধায়ক বা অধিনায়ক।এই পদের ইতিহাস প্রায় ৮৪০ বছরের পুরোনো। ১১৮৫ সালে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্তাস, জেনারেল আলবারিক ক্লেমেন্টকে বিশ্বের প্রথম ফিল্ড মার্শাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
এই পদে থাকা ব্যক্তি আজীবনের জন্য ওই মর্যাদা ধারণ করেন। একজন ফিল্ড মার্শালের নিজস্ব প্রতীক ও লাঠি থাকে। তারা সাধারণত স্যালুটের উত্তর দেন না, বরং একটি লাঠি নাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। পাকিস্তানে এই পদ এতটাই বিরল যে স্বাধীনতার পর কেবলমাত্র আইয়ুব খান এটি পেয়েছিলেন।
ভারতেও ফিল্ড মার্শাল পদ আছে – এবং তা একইরকম বিরল। মাত্র দুইজন ভারতীয় সেনাপ্রধান স্বাধীনতার পর এই পদ পেয়েছেন—স্যাম মানেকশ (১৯৭৩ সালে) এবং কে এম কারিয়াপ্পা (১৯৮৬ সালে)। মানেকশ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় অর্জন করায় তাকে এই উপাধি দেওয়া হয়।
এছাড়াও যারা ইতিহাসের বিভিন্ন সময় ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা পেয়েছিলেন – যুক্তরাজ্যে ১৪১ জন এবং রুশ সাম্রাজ্যে ৬৪ জন ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা পেয়েছিলেন।
ফ্রান্সে ১৭৯৩ থেকে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত এই পদটি বিলুপ্ত অবস্থায় ছিল। তবে পরে এই পদটি আবার প্রবর্তন করা হয় এবং খোদ নেপোলিয়ন নিজেই ফিল্ড মার্শাল হন। জার্মানিতে এই পদটি চালু হয় ১৬৩১ সালে। জার্মানির প্রথম ফিল্ড মার্শাল ছিলেন জেনারেল হান্স বয়েটজেনবুর্গ।
১৭০০ সালে রাশিয়ার কাউন্ট গোলভিন ফিল্ড মার্শাল হন। ১৭৩৬ সালে ব্রিটেনের জেনারেল জর্জ হ্যামিল্টন এই পদে ভূষিত হন। ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’ ও ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি’ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
তামিল টাইগারদের পরাজিত করার পুরস্কার হিসেবে শ্রীলঙ্কার সেনাপ্রধান সারথ ফনসেকাও এই পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হলেও রাজাপক্ষের কাছে পরাজিত হন। পরে তাঁকে এই পদ ও সম্মাননা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে ২০১৫ সালে নতুন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা সাবেক এই সেনাপ্রধানকে পূর্ণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং আবার ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করেন।
নেপালের রাজা বীরেন্দ্র ও মহেন্দ্র ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল ছিলেন। ব্রিটেন, প্রায় এক ডজন বিদেশি রাজাকে কূটনৈতিক সম্মানের দৃষ্টান্ত হিসেবে এ খেতাব দিয়েছে।
তবে জার্মান সম্রাট উইলহেল্ম দ্বিতীয়, অস্ট্রিয়ার সম্রাট ফ্রান্স জোসেফ প্রথম এবং জাপানের সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে এই পদ কেড়ে নেওয়া হয়। কারণ, দুই বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁদের নিজ নিজ দেশ ব্রিটেনের শত্রু হয়ে ওঠায় তাঁদের সরানো হয়।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী আর্থার ওয়েলেসলি ১৮১৩ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে এই পদ পান। ১৮২১ সালে ৯১ বছর বয়সে চার্লস মুর এই পদ পেয়েছিলেন। ব্রিটেনে এমন ২৩ জন কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা ৮০ বা তার বেশি বয়সে ফিল্ড মার্শাল হয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যেও অনেকে এই পদ পেয়েছেন, যেমন রাজা জর্জ পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, প্রিন্স চার্লস, প্রিন্স এডওয়ার্ড এবং রানি এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ।
রানি ভিক্টোরিয়া তাঁর স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টকে ফিল্ড মার্শাল পদ দিয়েছিলেন। তাঁর নাতনি রানি এলিজাবেথও একই কাজ করেন। জেনারেল চার্লস গাথরি ২০১২ সালে ও জেনারেল জন ওয়াকার ২০১৪ সালে এই পদে উন্নীত হন। তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কও একজন ফিল্ড মার্শাল ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে কখনো ফিল্ড মার্শাল পদ চালু হয়নি। তবে ১৯৩৬ সালে জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থারকে ফিলিপিনো সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল পদে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৪ সালে মার্কিন কংগ্রেস ‘জেনারেল অব দ্য আর্মি’ নামে একটি পাঁচ তারকা পদ চালু করে, যা ফিল্ড মার্শালের সমতুল্য।
সৌদি আরবে ১৯৯০-৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে অবদানের জন্য প্রিন্স খালেদ বিন সুলতানকে এই পদে উন্নীত করেন বাদশাহ ফাহদ।
বহু দেশের সামরিক বাহিনীতে মর্যাদাপূর্ণ এই পদ দেখা গেছে যেমন– গ্রেট ব্রিটেন, ভারত, পাকিস্তান, চীন, ফিনল্যান্ড, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, ইতালি, ব্রুনেই, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, গ্রিস, জাপান, তুরস্ক, সৌদি আরব, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, সুইডেন, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, ব্রাজিল, ওমান, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, জায়ার, নেপাল, মঙ্গোলিয়া, ইথিওপিয়া, মিসর, বেলারুশ, বাহরাইন, ইয়েমেন, ফিলিপাইন, পেরু, উত্তর কোরিয়া, ঘানা, যুগোস্লাভিয়া, ভেনেজুয়েলা, উগান্ডা, জর্ডান, ইরান, ইরাক, লাইবেরিয়া, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, মধ্য আফ্রিকান রিপাবলিক, তিউনিসিয়া, সুদান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, সার্বিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি দেশ।
তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন ফিল্ড মার্শাল হওয়া মূলত একটি আনুষ্ঠানিক সম্মান। এটি বাস্তব ক্ষমতার দিক থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্বে খুব বেশি পরিবর্তন আনে না।
Leave a comment