গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ের এক সকালে সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো এবং গণভবনে কবর দিয়ে দাও।” এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক শুনানিতে।
মামলার চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম গত ২৫ মে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর শুনানিতে এই সব বিস্ফোরক তথ্য উপস্থাপন করেন। এতে তিনি ২০২৪ সালের ৪ ও ৫ আগস্ট গণভবনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ভেতরের টানাপোড়েন ও সিদ্ধান্তহীনতার চিত্র তুলে ধরেন।
তাজুল ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, ৪ আগস্ট গভীর রাতে গণভবনে এক গোপন বৈঠকে অংশ নেন তিন বাহিনীর প্রধান, প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রীরা। বৈঠকে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের আহ্বান জানান উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক। শেখ হাসিনা এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং সেনাপ্রধানকে নির্দেশ দেন, যেভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে হবে।
সেই মুহূর্তে তারিক সিদ্দিক প্রস্তাব দেন, হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা হোক। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিমানবাহিনী প্রধান বলেন, “তিনি (তারিক) আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডুবাবে।”
শেখ হাসিনাকে কঠোর অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেন ‘গ্যাং অব ফোর’ নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের চার শীর্ষ নেতা—ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমান।
৫ আগস্ট সকালে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। বৈঠকে পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জানান, পুলিশ বাহিনী ক্লান্ত, অস্ত্র-গোলাবারুদ প্রায় শেষ, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। তখন সেনা কর্মকর্তারা আবারও শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের অনুরোধ করেন।
এই সময় শেখ হাসিনা উত্তেজনায় বলে ওঠেন, “তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো এবং এখানে কবর দিয়ে দাও।”
চিফ প্রসিকিউটর জানান, এরপর সেনা কর্মকর্তারা তাঁকে আলাদা কক্ষে নিয়ে গিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝান। ছোট বোন শেখ রেহানা শেখ হাসিনাকে বোঝাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং পা জড়িয়ে ধরেন। শেখ হাসিনা তখনো অনড় ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত সামরিক কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে। তাঁকে জানানো হয়, তাঁর মা যদি পদত্যাগ না করেন, তাহলে তাঁর প্রাণনাশের সম্ভাবনা আছে। জয় পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে মাকে বোঝান। তাঁর কথাতেই শেখ হাসিনা রাজি হন ক্ষমতা ছাড়তে।
তাজুল ইসলাম আরও জানান, শেখ হাসিনা তখন একটি বিদায়ী ভাষণ রেকর্ড করে প্রচার করতে চাইলেও, সেনাবাহিনী তাতে রাজি হয়নি।
বেলা ১১টায় সেনাবাহিনীর জনসংযোগ দপ্তর (আইএসপিআর) বিটিভিকে জানায়, সেনাপ্রধান বিকেল ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। যদিও সেই ভাষণ সম্প্রচারিত হয় বিকেল ৪টায়। তার আগেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে উত্থাপিত এই বিবরণ গণভবনের অভ্যন্তরীণ নাটকীয়তা, নেতিবাচক অবস্থান এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘনঘটায় ভরা সেই মুহূর্তের এক বিরল অন্তরঙ্গ চিত্র প্রকাশ করে।
Leave a comment