ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি সামরিক হামলার প্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়ায় এক নজিরবিহীন যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ১০ মে ভোরে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা ভারতের সাতটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। এর আগে ইসলামাবাদের দাবি, ভারত প্রথমে তাদের তিনটি সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পাল্টাপাল্টি এই হামলাগুলো কেবল যুদ্ধের আশঙ্কা নয়, বরং দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে ভয়াবহ সংঘাতের প্রেক্ষাপট তৈরি করছে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার সূচনা ঘটে গত ২২ এপ্রিল, ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে এক সশস্ত্র হামলায় ২৬ জন নিহতের ঘটনায়। ভারত এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও ইসলামাবাদ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে। শুরুতে কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উত্তেজনা সীমাবদ্ধ থাকলেও দ্রুতই তা সামরিক আকার ধারণ করে। গোলাবর্ষণ, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা এখন নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, উত্তেজনা যদি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়, তবে তা পারমাণবিক শক্তিধর দুটি দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি যুদ্ধ হবে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড্যান স্মিথ বলেন, ‘পারমাণবিক হামলা চালানো উভয় পক্ষের জন্যই নিছক আত্মঘাতী পদক্ষেপ হবে। সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
ভারতের একমাত্র ও আনুষ্ঠানিক পারমাণবিক নীতিমালা গৃহীত হয় ২০০৩ সালে। এই নীতিমালার চারটি স্তম্ভ হলো:
১. প্রথমে ব্যবহার নয় (No First Use) — কেবল শত্রুপক্ষ পারমাণবিক হামলা চালালে ভারত পাল্টা হামলা চালাবে।
২. নির্ভরযোগ্য ন্যূনতম প্রতিরোধক্ষমতা — সীমিত অস্ত্রভাণ্ডার হলেও তা প্রতিপক্ষকে নিরুৎসাহিত করতে যথেষ্ট।
৩. ভয়াবহ প্রতিশোধ — পারমাণবিক হামলার জবাবে ভারতের পাল্টা আঘাত ধ্বংসাত্মক হবে।
৪. জীবাণু বা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে ব্যতিক্রম — এ ধরনের হামলায় ভারত পারমাণবিক জবাব দিতে পারে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই নীতির ওপর প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হতে পারে। এতে ভারতের ‘প্রথমে ব্যবহার নয়’ নীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা বাড়ে।
পাকিস্তান কখনোই কোনো লিখিত বা স্পষ্ট পারমাণবিক নীতি ঘোষণা করেনি। এই অনিশ্চয়তাকেই একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আসছে তারা। ২০০১ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল খালিদ কিদওয়াই চারটি ‘রেড লাইন’ নির্ধারণ করেন, যার মধ্যে রয়েছে ভূখণ্ডগত ক্ষতি, সামরিক ক্ষতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
তবে ২০২৪ সালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের এখন আর ‘প্রথমে পারমাণবিক হামলা করার’ কোনো নীতি নেই।
পাকিস্তান ২০১১ সাল থেকে ‘ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার উইপনস’ (TNWs) তৈরি করছে—এ ধরনের স্বল্পপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষয়ক্ষতির জন্য ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে ভারতের হাতে প্রায় ১৮০টি এবং পাকিস্তানের হাতে ১৭০টির বেশি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। ভারত রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে সাবমেরিনভিত্তিক উৎক্ষেপণ ব্যবস্থাও তৈরি করছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় মধ্যপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রভিত্তিক অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করছে।
উভয় দেশের এই অস্ত্রভাণ্ডার কেবল প্রতিরোধের জন্য হলেও, চলমান উত্তেজনা ও জবাব পাল্টা জবাবের রাজনীতি এই অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিকে বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে আসছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা প্রতিদিন নতুন মাত্রা পাচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা এখনো কম হলেও, উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে একটি ভুল হিসাব কিংবা ভুল বোঝাবুঝি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আন্তর্জাতিক মহল উভয় পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানালেও এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—সীমান্তের ওপার থেকে ছোঁড়া আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র কি পারমাণবিক যুদ্ধের সূচনা করে দেবে?
Leave a comment