ব্যতিক্রমী আয়োজন, হৃদয় ছোঁয়া আবেগ, আর ঘোড়ার গাড়িতে রাজকীয় প্রস্থান— এমন দৃশ্যই দেখা গেল নাটোরের বাগাতিপাড়া সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে। রবিবার (২ নভেম্বর) সকালে দীর্ঘ ২৭ বছরের শিক্ষকজীবনের ইতি টেনে কারিগরি বিভাগের সহকারী শিক্ষক (টেকনিক্যাল) দিলীপ কুমার সরকার অবসরে গেলেন ।
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সহকর্মী শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের উপস্থিতিতে আয়োজিত বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি পরিণত হয় এক স্মরণীয় মুহূর্তে।
সকালে বিদ্যালয় মাঠে ফুলে সজ্জিত মঞ্চে শুরু হয় বিদায় সংবর্ধনা। শিক্ষার্থীরা প্রিয় শিক্ষককে ফুলের তোড়া ও শুভেচ্ছা জানায়, আর বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হয় সম্মাননা ক্রেস্ট। অনুষ্ঠান শেষে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন দিলীপ কুমার সরকার। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই তখন অশ্রুসজল নয়নে প্রিয় শিক্ষককে বিদায় জানান। উপস্থিতদের অনেকে বলেন, এই দৃশ্য তাদের জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (চলতি দায়িত্ব) অনিতা রানী বলেন,“দিলীপ কুমার সরকার ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী ও দায়িত্বশীল শিক্ষক। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ের টেকনিক্যাল বিভাগে এসেছে বহু সাফল্য। তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন, ছিলেন শিক্ষার্থীদের পথপ্রদর্শক ও অনুপ্রেরণার উৎস।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা তার মতো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক পেয়ে সৌভাগ্যবান। তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।” বিদায়ী শিক্ষক দিলীপ কুমার সরকার বলেন,“এই বিদ্যালয় আমার দ্বিতীয় পরিবার। সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই বিদায় আমার কাছে যেমন গর্বের, তেমনি গভীর আবেগেরও।”
তিনি আরও বলেন, “২৭ বছরের শিক্ষকজীবনে আমি চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ জাগাতে। আজ তাদের ভালোবাসাই আমার পরিশ্রমের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি।” দিলীপ কুমার সরকার ১৯৯৮ সালের ২ মে বাগাতিপাড়া সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে কারিগরি বিভাগের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কর্মজীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি নিষ্ঠা, সততা ও দায়িত্ববোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
তার তত্ত্বাবধানে বিদ্যালয়ের কারিগরি বিভাগ একাধিকবার উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পুরস্কার অর্জন করে। শিক্ষার্থীরা জানান, “স্যার ক্লাসে কখনোই কেবল বইয়ের পাঠে সীমাবদ্ধ থাকতেন না, জীবনের বাস্তব শিক্ষা দিতেন।”
ফুলে সাজানো ঘোড়ার গাড়িতে প্রিয় শিক্ষককে বিদায় জানানো দৃশ্যটি ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রাক্তন ছাত্ররা ফেসবুকে নানা আবেগঘন পোস্ট দিয়ে প্রিয় শিক্ষককে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। এমন বিদায়ের আয়োজনকে অনেকেই বলেছেন, “এটাই একজন প্রকৃত শিক্ষকের প্রাপ্য সম্মান।”
দীর্ঘ ২৭ বছরের নিষ্ঠা ও কর্মনিষ্ঠার পর ঘোড়ার গাড়িতে করে বিদ্যালয় ছাড়লেন দিলীপ কুমার সরকার। বিদায়বেলায় চারপাশে শিক্ষার্থীদের চোখে জল, হাতে ফুল, আর মুখে একটাই কথা—“স্যার, আপনি আমাদের হৃদয়ে থাকবেন চিরকাল।”
Leave a comment