জাতীয় রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সদস্যসচিব মীর আরশাদুল হক। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে তিনি এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন ঘোষণা করেছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে, তারেক রহমানের দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার দিনেই, নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে পদত্যাগের ঘোষণা দেন মীর আরশাদুল। ‘একটি বিশেষ ঘোষণা’ শিরোনামে দেওয়া ওই পোস্টে তিনি জানান, এনসিপির সঙ্গে তাঁর আর কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম–১৬ আসনে এনসিপির প্রার্থী হিসেবেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।
মীর আরশাদুল হক এনসিপিতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিবের পাশাপাশি তিনি দলের নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য, মিডিয়া সেল ও শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য, পরিবেশ সেলের প্রধান এবং চট্টগ্রাম মহানগরের প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়নও পেয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (ডুজা) সাবেক সহসভাপতি হিসেবেও পরিচিত।
ছাত্রজীবন থেকেই সাংবাদিকতা ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মীর আরশাদুল। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি প্রথমে জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দেন। পরে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের উদ্যোগে এনসিপি গঠিত হলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আশায় দলটিতে যুক্ত হন।
তবে এনসিপিতে প্রায় ১০ মাসের অভিজ্ঞতা থেকে হতাশার কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। ফেসবুক পোস্টে মীর আরশাদুল লেখেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এনসিপির যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে দলটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর ভাষায়, “যে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা দেখে এনসিপিতে যোগ দিয়েছিলাম, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। দল ও বড় অংশের নেতারা ভুল পথে হাঁটছেন বলেই আমি মনে করি।”
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিকভাবে ভুল পথে চলার দায় তিনি নিতে চান না। সে কারণেই এই মুহূর্ত থেকে এনসিপির সঙ্গে তাঁর সব ধরনের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকবে বলেও উল্লেখ করেন এবং সাবেক সহকর্মীদের প্রতি শুভকামনা জানান।
পদত্যাগ ঘোষণার পাশাপাশি মীর আরশাদুল হক স্পষ্টভাবে তারেক রহমানের নেতৃত্বে আস্থা রাখার কথা জানান। তাঁর মতে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাই সবচেয়ে জরুরি। এ ক্ষেত্রে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ও তাদের জোটের সরকার গঠনের বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে মীর আরশাদুল বলেন, এই মুহূর্তে সব শ্রেণি ও মতকে একত্রে ধারণ করে দেশ পরিচালনার দক্ষতা ও সক্ষমতা তারেক রহমানের মধ্যেই রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, যখন অন্য রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় আবেগ ও পপুলিজমকে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে, তখন তারেক রহমান স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে একটি স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত ভিশন তুলে ধরছেন।
মীর আরশাদুলের মতে, জনগণের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, সংস্কৃতি ও কর্মসংস্থান—এই খাতগুলোতে সুনির্দিষ্ট সমাধানের কথা বলছেন তারেক রহমান, যা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আকৃষ্ট করেছে। তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, কোনো ধরনের হুজুগ বা পপুলিজমে না ভেসে দেশের সামগ্রিক স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিয়ে জনকল্যাণমূলক রাজনীতির পাশে দাঁড়ানো উচিত।
এনসিপির ভেতরের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও মীর আরশাদুলের পদত্যাগের পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনে
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা নিয়ে দলের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। দলটির একটি অংশ এই সমঝোতার পক্ষে থাকলেও অন্য অংশের বিরোধিতা রয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় অনাগ্রহী নেতাদের অন্যতম ছিলেন মীর আরশাদুল হক।
এ বিষয়ে সরাসরি যোগাযোগ করা হলে মীর আরশাদুল বলেন, “এনসিপি সামগ্রিকভাবে ভুল পথে চলে গেছে। তারা তরুণদের একটি কার্যকর নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে। এই দলে থেকে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ও কঠিন সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
তিনি আরও জানান, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেনের কাছে ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একজন কেন্দ্রীয় নেতার এমন প্রকাশ্য পদত্যাগ ও ভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির প্রতি সমর্থন ঘোষণা এনসিপির জন্য একটি বড় ধাক্কা হতে পারে।
Leave a comment