পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিককে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করেছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪। রায়ে বলা হয়েছে—তিনি নিজে প্লট নেননি, তবে মা শেখ রেহানার জন্য প্লট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে ক্ষমতার প্রভাব খাটান এবং এ প্রক্রিয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্ররোচিত করেন। একই মামলায় প্লটগ্রহীতা শেখ রেহানাকে সাত বছর এবং শেখ হাসিনাসহ আরও ১৪ জনকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত উল্লেখ করেছে—
• শেখ রেহানা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্ররোচিত করে প্লট নিয়েছেন।
• টিউলিপ সিদ্দিক মায়ের জন্য প্লট পেতে মোবাইল,,ইন্টারনেট অ্যাপ এবং বাংলাদেশে এলে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে
শেখ হাসিনা ও তার একান্ত সচিব সালাউদ্দিন আহমেদকে প্রভাবিত করেছেন।
দুইজন সাক্ষীর জবানবন্দিতে এই যোগাযোগের কথিত দাবি উঠে এসেছে। তবে এই যোগাযোগের কোনো স্ক্রিনশট, ডিজিটাল নথি বা লিখিত প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি বলে মামলার স্পেশাল পিপি তরিকুল ইসলাম জানিয়েছে । তিনি স্বীকার করেন—“মেসেজের কোনো স্ক্রিনশট আমাদের কাছে নেই।” তবে সাক্ষী দুজন সালাউদ্দিন আহমেদের ‘ঘনিষ্ঠ’ এবং তিনিও টিউলিপ ও শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে দাবি করেন
দুর্নীতি কীভাবে প্রমাণিত হল—আদালতের বক্তব্য
• শেখ হাসিনা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অধীনস্ত কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে প্লট বরাদ্দ করেছেন, যা ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট।
• অন্যান্য সরকারি কর্মচারীরা বিধিবিধান লঙ্ঘন করে প্লট বরাদ্দে সহায়তা করেছেন।
• টিউলিপ সিদ্দিক প্ররোচনা ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে দুর্নীতি চক্রকে সহায়তা করেছেন।
এ অভিযোগ প্রধানত দুই সাক্ষীর মৌখিক জবানবন্দির ওপর নির্ভর করেই প্রমাণিত হয়েছে।
পলাতক আসামিদের আইনজীবী পাওয়ার সুযোগ কেন ছিল না?
১৭ আসামির মধ্যে কেবল খুরশিদ আলম আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। বাকিদের ‘পলাতক’ ধরে বিচার করা হয়।
বিচারক ব্যাখ্যা দেন—বাংলাদেশি নাগরিক হলে বিশ্বের যেকোনো স্থানে থাকলেও বিচার করতে বাধা নেই। আদালতে হাজিরা ও আত্মসমর্পণের নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তারা হাজির না হওয়ায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডযোগ্য নয় এমন মামলায় পলাতক আসামির জন্য রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী দেওয়ার বিধান নেই। ফলে আদালতের মতে, পলাতক থাকার কারণে তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেননি।
টিউলিপ সিদ্দিকের প্রতিক্রিয়া: ‘এটি প্রহসনমূলক বিচার’
রায়ের পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান ও বিবিসিকে টিউলিপ সিদ্দিক বলেন—বিচার প্রক্রিয়াটি “ত্রুটিপূর্ণ, প্রহসনমূলক এবং ক্যাঙ্গারু কোর্টের রায়”। তার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ দেখানো হয়েছে—তা জাল।
তিনি বলেন,“আমাকে কোনো সমন, কোনো চার্জশিট দেওয়া হয়নি; কোনো কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে যোগাযোগও করেনি।”
তিনি দাবি করেন, তার কোনো বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেই এবং কখনো বাংলাদেশে কর দেননি। রায়কে তিনি “মিডিয়া ট্রায়াল” বলে মন্তব্য করেন। যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি জানিয়েছে— টিউলিপ সিদ্দিককে ন্যায্য আইনি প্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি, তাই তারা এই রায়কে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
সাজা কীভাবে কার্যকর হবে?
দুদকের আইনজীবী জানান— রায় কমিশনকে জানানো হবে, এরপর সরকার কূটনৈতিক চ্যানেলে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যুক্তরাজ্যে এমপি হলেও টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের নাগরিক ও ভোটার হিসেবেই বিবেচিত হবে—এমন দাবি করেছে দুদক। পূর্বাচল প্রকল্পের ছয়টি প্লট বরাদ্দে ৬০ কাঠার অনিয়মের অভিযোগে গত ডিসেম্বর থেকে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে করা ছয় মামলার মধ্যে চারটির রায় ইতোমধ্যে ঘোষণা হয়েছে। টিউলিপের ভাই রাদওয়ান মুজিব ও বোন আজমিনা সিদ্দিক রুপন্তীর বিরুদ্ধেও দুই মামলার বিচার চলছে।
Leave a comment