জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে চার বছরের শিশু নুসরাত জাহান হাবিবার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে তার আপন চাচা আমির হামজা ও বাবার চাচাতো ভাই আল-আমিন আদালতে বিস্তারিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রোববার (৭ ডিসেম্বর) রাতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তাদের গ্রেফতার করার পর এই জবানবন্দি নেওয়া হয়।
পিবিআই-এর তদন্তে উঠে এসেছে, টাকার লোভে দুই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মিলে এই নির্মম অপরাধটি সংঘটিত করেছিল। তাদের স্বীকারোক্তিতে হত্যার আগে এবং পরে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার চিত্র উন্মোচিত হয়েছে, যা স্থানীয় এলাকাবাসীসহ পুরো দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সকাল আটটার দিকে নুসরাতের বাবা তাকে বাজারে নিয়ে যান। ফেরার পথে একটি দোকান থেকে সিঙাড়া কিনে দিয়ে ছোট্ট মেয়েটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তিন ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরে তিনি জানতে পারেন, মেয়েটি এখনও বাড়ি পৌঁছায়নি।
সন্ধান করতে না পেরে ১০ সেপ্টেম্বর দেওয়ানগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরদিন ১১ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বাড়ির আঙিনায় জখম অবস্থায় নুসরাতের লাশ পাওয়া যায়। এরপর অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে তার বাবা মামলা করেন। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই জামালপুর ইউনিট।
পিবিআই-এর তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই স্বপন মিয়ার নেতৃত্বে প্রযুক্তিভিত্তিক তদন্তে প্রথমেই সন্দেহভাজন হিসেবে উঠে আসে শিশুটির আপন চাচা আমির হামজার নাম। তাকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হলে তিনি ঘটনার বর্ণনা দেন এবং তার সহযোগী হিসেবে আল-আমিনের নাম জানান। একই রাতে আল-আমিনকেও গ্রেফতার করা হয়। দুজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মর্মান্তিক ঘটনাটির বিস্তারিত দিয়েছেন।
স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, টাকার লোভে তারা নুসরাতকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। ৯ সেপ্টেম্বর সকালে শিশুটি বাড়ির পাশে রাস্তায় একা হাঁটছিল। সেই সুযোগে আমির হামজা ও আল-আমিন তাকে জোর করে তুলে নেয় এবং মুখ চেপে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যায়।
সেখানে শ্বাসরোধে শিশুটিকে অচেতন করে ফেলা হয়। এই পরিস্থিতিতে আল-আমিন তাকে নির্যাতন করে। কিছুক্ষণ পর নুসরাতের জ্ঞান ফিরলে সে কান্না শুরু করে, চিৎকার করে ওঠে। এতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তারা আবার মুখ চেপে ধরে। এতে চার বছরের ওই শিশুটির মৃত্যু হয়।
শিশুটির মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর দুজনই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তদন্তে জানা যায়, অপরাধ লুকাতে তারা শিশুটির দেহে ব্যাটারির এসিড ঢেলে বিকৃত করার চেষ্টা করে। প্রথমে জঙ্গলে পাতা দিয়ে লাশ ঢেকে রাখা হয়।
রাত গভীর হলে লাশটি নদীর দিকে নিয়ে গিয়ে কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে রাখা হয়। কিন্তু পরদিন তারা সিদ্ধান্ত বদলে মৃতদেহটি আবার বাড়ির কাছে এনে ফেলে রাখে, যেন এটি কোনো দুর্বৃত্তের কাজ বলে মনে হয়।
পিবিআই জামালপুরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন,“এটি অত্যন্ত নৃশংস ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। টাকার লোভে নিজের পরিবারের চার বছরের শিশুকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যা—এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত বিরল এবং গভীরভাবে উদ্বেগজনক।” তিনি আরও জানান, জবানবন্দি, ফরেনসিক প্রমাণ এবং প্রযুক্তিগত তথ্য মিলিয়ে চার্জশিট দাখিলের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে।
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর দেওয়ানগঞ্জের বাঘারচর এলাকায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন। পরিবার শোকে ভেঙে পড়েছে, এখনও নুসরাতের মা-বাবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেননি।
Leave a comment