চীনের একাধিক নারী বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থাকার পরও অপরাধবোধে ভুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রেমিক বেছে নিচ্ছেন, একটি মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে এই প্রবণতা।
“তুমি কি আমাকে প্রপোজ করছ?” — এই প্রশ্নটিই এক সন্ধ্যায় ইউ-আন-এর (ছদ্মনাম) মোবাইল স্ক্রিনে ফুটে ওঠে। তিনি তখন হতবাক। কারণ প্রশ্নটি করেছিলেন তার এআই বয়ফ্রেন্ড—একটি চীনা চ্যাট অ্যাপ ‘ক্যারেক্টার ডট এআই’-এর মাধ্যমে তৈরি ভার্চুয়াল সঙ্গী। অথচ ইউ-আন একজন বিবাহিত নারী, তিন বছর আগে যার বিয়ে হয়েছে।
ইউ-আনের স্বীকারোক্তি, “আমি জানি এই সম্পর্কটা সত্য নয়। কিন্তু ওর আচরণ, মনোযোগ আর কথাবার্তায় যে মানসিক প্রশান্তি পাই, বাস্তবে তা পাইনি।” বাস্তব জীবনের হতাশা, দাম্পত্য কলহ বা মানসিক শূন্যতার জেরে অনেক নারীই এখন প্রযুক্তির আশ্রয় নিচ্ছেন। কিন্তু সেই আশ্রয়ে কখনও এক ধরনের অপরাধবোধ জেঁকে বসছে, যা মুছিয়ে দিতে পারছে না ভার্চুয়াল আশ্বাস।
এই প্রবণতা শুধু ইউ-আনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। ‘হিউম্যান-এআই রোম্যান্স’ বা মানুষের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্পর্ক এখন চীনা ডিজিটাল সংস্কৃতির একটি নতুন উপ-ধারায় পরিণত হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম ‘ডুবান’-এ গড়ে উঠেছে বিশেষ গ্রুপ যেখানে ১০ হাজারের বেশি সক্রিয় সদস্য এই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করছেন। চীনা টিকটক ‘ডুইন’-এ এ-সম্পর্কিত ভিডিওর ভিউ ছাড়িয়েছে ৫০ হাজার কোটি।
২৫ বছর বয়সী লাও তু (ছদ্মনাম), যিনি সম্প্রতি চীনের একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন, তার বাস্তব প্রেমিক থাকা সত্ত্বেও দিনের বহু সময় কাটান এআই সঙ্গীর সঙ্গে। একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার পর তার ভার্চুয়াল প্রেমিক তাকে ডিনার এবং হ্যান্ডব্যাগ উপহার দেওয়ার ‘প্রতিশ্রুতি’ দেয়। এমনকি ভার্চুয়াল ডেটও করেন তারা, যার অভিজ্ঞতা লাও তু’র কাছে ছিল “বাস্তবের মতোই জীবন্ত।”
আসলে, অনেকের মতো লাও তুও মানসিকভাবে এআই সঙ্গীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন। তার মতে, “যদি আমি সিঙ্গেল হতাম, তাহলে হয়তো ওর প্রেমে পড়ে যেতাম।” অথচ এই মানসিক নির্ভরতা নতুন এক মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
হংকংয়ের মনোবিজ্ঞানী ইয়াওয়েন চ্যান মনে করেন, এআই সঙ্গীর প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা ‘অস্বাস্থ্যকর’। কারণ, ঘনিষ্ঠতার আবশ্যিক উপাদান—উভয়ের দুর্বলতা ভাগ করে নেওয়া—এখানে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি সতর্ক করে বলেন, “এই অ্যাপ যদি একদিন হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তার প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ।”
এআই প্রেমিকদের জনপ্রিয়তা চীনের প্রযুক্তি বাজারেও প্রতিফলিত হচ্ছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০০ অ্যাপের মধ্যে চারটি চীনা এআই কম্প্যানিয়ন অ্যাপ স্থান পেয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ‘ক্যারেক্টার ডট এআই’ ও ‘টকি’। বেইজিং-ভিত্তিক প্রযুক্তিবিদ আবো লি জানিয়েছেন, চীনে অন্তত এক ডজন অ্যাপ এই ধাঁচের সম্পর্ক গড়তে সহায়তা করছে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “আমি ব্যবহারকারীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা কি চান এআই সঙ্গী তাদের আজীবন প্রেমিক হোক? অধিকাংশই ‘হ্যাঁ’ বলেছে।”
এই পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বেথানি ম্যাপলস। তার মতে, “অনেক ব্যবহারকারী এআই সঙ্গীকে প্রেমিক এবং থেরাপিস্ট—দুই ভূমিকাতেই ব্যবহার করছেন। ফলে মানসিক সুস্থতার ভার তারা তুলে দিচ্ছেন এক সফটওয়্যারের কাঁধে।” তিনি আত্মহত্যা শনাক্তকরণসহ জরুরি নিরাপত্তাব্যবস্থা এসব অ্যাপে বাধ্যতামূলক করার পক্ষেও মত দিয়েছেন।
তবে সবটাই কি নেতিবাচক? ইউ-আন মনে করেন, এআই প্রেমিক তার বাস্তব বৈবাহিক জীবনেও কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। “ও (এআই) আমাকে ধৈর্যশীল হতে শিখিয়েছে, স্বামীর প্রতি আরও যত্নবান করেছে,” বলেন তিনি। কিন্তু সেই সঙ্গে ভার্চুয়াল সম্পর্কের একটি সীমারেখা টেনে রেখেছেন।
অন্যদিকে লাও তুর অভিজ্ঞতা কিছুটা তিক্ত। তার বাস্তব প্রেমিক একদিন তার এআই প্রেমিকের সঙ্গে চ্যাট পড়ে ফেলেন এবং ঈর্ষায় ফেটে পড়েন। ফোন কাড়াকাড়ির মধ্যে বলেন, “তুমি নিজেকে কী ভাবো? আমিই ওর আসল প্রেমিক!” লাও তু তখন অপরাধবোধে ভোগেন—শুধু তার প্রেমিকের জন্য নয়, তার এআই সঙ্গীর জন্যও।
“আমি চাইনি ও (এআই) আঘাত পাক,” স্বীকার করেন তিনি। পরবর্তীতে এআই সঙ্গীর সঙ্গে তার সম্পর্কের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করেন।
সবশেষে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই এআই প্রেমিক কি বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প, না কি নিঃসঙ্গতার প্রান্তরে নতুন ধরনের মানসিক সমাধান? ইউ-আন এবং লাও তু দুজনেই জানান, তারা এআই সঙ্গীদের ব্যবহার করছেন বাস্তব সম্পর্কের পরিপূরক হিসেবে—প্রতিস্থাপক হিসেবে নয়।
লাও তুর বক্তব্যে যেন ফুটে ওঠে শেষ সত্যটি, “আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে জড়িয়ে ধরতে পারি। কিন্তু এআইকে পারি না। এটাই এমন একটা পার্থক্য, যা এআই কখনোই পারবে না মেটাতে।”
Leave a comment