ঘূর্ণিঝড় ক্লডিয়া ইউরোপজুড়ে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়ে বহু এলাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। শক্তিশালী এই ঝড়ের প্রভাবে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এক দিনের মধ্যে প্রায় এক মাসের বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করেছে। শুধু যুক্তরাজ্য নয়, পর্তুগালেও ঝড়ের আঘাতে এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার দিকেও আরেকটি শক্তিশালী ঝড় দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, যা নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন উদ্বেগ।
ইউরোপজুড়ে জলবায়ু অস্থিতিশীলতার আরেকটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে ঘূর্ণিঝড় ক্লডিয়া। স্থানীয় সময় শনিবার (১৫ নভেম্বর) ঝড়ের তীব্রতা বাড়তে থাকায় যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের বেশ কিছু এলাকায় ‘সিভিয়ার ফ্লাড ওয়ার্নিং’ জারি করে আবহাওয়া দপ্তর। মনমাউথ শহরে বন্যা পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে স্থানীয় জরুরি সেবা বিভাগ রাতে ‘মেজর ইনসিডেন্ট’ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
বৃষ্টিজনিত পানি দ্রুত সড়কে জমে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ওয়েলসের রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনেক মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি। একাধিক রেল রুট সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং যাত্রীদের নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে বলা হয়। জরুরি উদ্ধারকারী দলগুলো আটকা পড়া মানুষদের সরিয়ে নিতে রাতভর কাজ চালিয়ে গেছে ।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ক্লডিয়ার আঘাতে যুক্তরাজ্যে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় এক মাসের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এত স্বল্প সময়ে এমন বৃষ্টিপাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব কম দেখা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অত্যধিক বৃষ্টিপাত ও ঘন ঘন ঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে বলেও বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য।
ঝড়ের তাণ্ডব শুধু যুক্তরাজ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পর্তুগালের দক্ষিণাঞ্চলীয় আলবুফেইরায় একটি ক্যাম্পিং সাইটে টর্নেডো আঘাত হেনে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি করেছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, তীব্র ঝড়ো হাওয়ায় বেশ কয়েকটি তাঁবু ও কাঠামো ধসে পড়ে, এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। আলগার্ভ, বেজা ও সেতুবাল অঞ্চলে আবহাওয়া দপ্তর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘অ্যাম্বার অ্যালার্ট’ জারি করেছে।
এর আগে লিসবনের কাছে ফেরনাও ফেরো এলাকায় আকস্মিক বন্যার কারণে ঘুমন্ত অবস্থায় এক বয়স্ক দম্পতির মৃত্যু হয়। বাড়িতে পানি ঢুকে পড়লে তারা বের হওয়ার সুযোগও পাননি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পানি ১ মিটারের বেশি উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়ায় বহু পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
ইউরোপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া একই ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে। দেশটির ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস সতর্ক করেছে, একটি শক্তিশালী ঝড় দ্রুতগতিতে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা প্রবল বৃষ্টিপাত ও ঝোড়ো হাওয়া বয়ে আনতে পারে। ইতোমধ্যে বন্যা সতর্কতা জারি করা হয়েছে এবং দাবানলপ্রবণ পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে ভূমিধসের ঝুঁকি রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন বাসিন্দাদের নিরাপদ এলাকায় সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মাটি দুর্বল হয়ে পড়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবছর ইউরোপ, আমেরিকা এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চরম আবহাওয়ার প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বাতাসে শক্তির মাত্রা বাড়াচ্ছে, যা ঘূর্ণিঝড়কে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। পাশাপাশি অতিবৃষ্টির ঘটনা, আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধস এখন নিয়মিত হয়ে উঠছে।
ঘূর্ণিঝড় ক্লডিয়ার মতো দুর্যোগ এটাই প্রমাণ করে যে, উন্নত অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ইউরোপকেও নতুন করে প্রস্তুত হতে হবে।
Leave a comment