বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে আজ। বিকেল ৪টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হবে বহুল প্রতীক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে এই সনদকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকনির্দেশনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি পুরো প্রক্রিয়াটির নেতৃত্ব দিয়েছেন শুরু থেকে। এছাড়া অনুষ্ঠানে কমিশনের সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
আট মাসের আলোচনার ফল আজ বাস্তবে-
প্রায় আট মাস ধরে তিন দফা আলোচনা, রাজনৈতিক পরামর্শ ও বিশেষজ্ঞ মতামতের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে এই সনদ। রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, সুশাসন, এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা—এই চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫।
এই সনদ প্রণয়নের সূচনা হয় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করে এবং ধাপে ধাপে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানায়।
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ও বৈঠক-
সনদ স্বাক্ষরের আগের বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে অনুষ্ঠিত হয় কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজে উপস্থিত থেকে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি তদারকি করেন। সভায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি (রব), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সভায় কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, “এই ঐতিহাসিক সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একটি যৌথ প্রতিশ্রুতিতে পৌঁছাবে। এটি রাষ্ট্র সংস্কারের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে এবং গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের পথ সুগম করবে।”
খসড়া থেকে চূড়ান্ত সনদ-
কমিশন প্রথমে ফেব্রুয়ারিতে একটি প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করে, যা আগস্ট মাসে সংশোধনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। প্রাথমিক খসড়ায় কিছু ত্রুটি চিহ্নিত হলে, ১৬ আগস্ট রাতে সংশোধিত সংস্করণ পাঠানো হয় দলগুলোর কাছে।
এরপর কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গ্রহণের শেষ সময়সীমা ২২ আগস্ট পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। সব মতামত পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত রূপে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ তৈরি করে গত ১৪ অক্টোবর প্রতিটি দলের হাতে হস্তান্তর করা হয়।
চূড়ান্ত কপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “সনদটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামো সংস্কারের জন্য একটি প্রাথমিক নীতি দলিল হিসেবে কাজ করবে, যা ভবিষ্যতের সংসদীয় সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক সংস্কারে দিকনির্দেশনা দেবে।”
রাষ্ট্র সংস্কারের নতুন দিগন্ত-
বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। এ সনদের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক সমঝোতা, এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারে দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা তৈরি হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সনদ শুধু দলীয় ঐক্য নয়—বরং এটি একটি জাতীয় রোডম্যাপ, যা আগামী প্রজন্মের জন্য স্থিতিশীল, ন্যায়ভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করবে।
জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক-
সনদ স্বাক্ষরের দিনটি তাই শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঐক্য, আলোচনাভিত্তিক নীতি এবং গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিকেল ৪টায় দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবেন, তখন উপস্থিত থাকবে দেশের প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্। এই মুহূর্তটি রাষ্ট্র সংস্কার ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের নতুন অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে।
Leave a comment