ব্ল্যাকমেইল, প্রতারণা ও তথাকথিত মামলা বাণিজ্যের অভিযোগে আলোচিত জুলাই আন্দোলনের পরিচিত মুখ তাহরিমা জান্নাত সুরভীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার নিজ বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। পুলিশ বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত একটি বড় অঙ্কের প্রতারণা মামলার তদন্তে তার সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ার পর এই গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, গুলশানের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ভয়ভীতি ও মামলার হুমকি দিয়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকা আদায়ের ঘটনায় তাহরিমা জান্নাত সুরভীর নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র সক্রিয় ছিল। এই চক্রটি পরিকল্পিতভাবে জুলাই আন্দোলনের নাম ও আবেগকে ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের মানসিক চাপে ফেলত এবং পরে অর্থ আদায় করত।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অভিযুক্ত চক্রটি গত বছরের জুলাই–আগস্ট মাসে রাজধানীর গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় সংঘটিত কয়েকটি হত্যা মামলার প্রসঙ্গ তুলে ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভয় দেখাত। তাদের বলা হতো, চাইলে এসব মামলায় নাম জড়িয়ে দেওয়া, গ্রেপ্তার করানো বা পুলিশি হয়রানির মুখে ফেলা সম্ভব। একই সঙ্গে ‘মীমাংসা’ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ধাপে ধাপে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হতো।
গুলশানের ওই ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে প্রথমে সীমিত অঙ্কের অর্থ নেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে চাপ বাড়িয়ে কোটি টাকার কাছাকাছি অর্থ আদায় করা হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, ভয় দেখানোর কৌশল হিসেবে আন্দোলনের সময়কার পরিচিতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে আরও জানা গেছে, এই চক্রটি শুধু একটি ঘটনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। বিভিন্ন সময় একাধিক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ব্ল্যাকমেইল ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য মিলেছে। যদিও এই অঙ্ক যাচাই-বাছাই এখনও চলমান, তবে একাধিক অভিযোগ ও আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা।
এক কর্মকর্তা জানান, “এটি একটি সংঘবদ্ধ অপরাধচক্র। প্রতিটি টার্গেট বাছাই করা হতো পরিকল্পিতভাবে। কার কত সম্পদ, কোথায় দুর্বলতা—সব তথ্য সংগ্রহের পর চাপ সৃষ্টি করা হতো।”
তাহরিমা জান্নাত সুরভী গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। জুলাই আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার উপস্থিতি, লাইভ ভিডিও এবং বক্তব্য দ্রুত ভাইরাল হয়। সে সময় নিজেকে ‘জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত করে তোলেন তিনি। পরবর্তীতে সেই পরিচিতিই তাকে সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত ও বিতর্কিত করে তোলে।
অভিযোগ রয়েছে, ভাইরাল পরিচিতিকে পুঁজি করে তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও রাজনৈতিক পরিচয়ের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। এরপর সেই যোগাযোগ ও পরিচিতির গল্প ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের ভয় দেখানো হতো।
পুলিশ জানিয়েছে, তাহরিমার বিরুদ্ধে একাধিক ধারায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গ্রেফতারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন করা হতে পারে। তদন্তের স্বার্থে তার মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট এবং আর্থিক লেনদেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “জুলাই আন্দোলনের মতো একটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নাম ব্যবহার করে কেউ যদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালায়, তাহলে সেটি শুধু আইন লঙ্ঘন নয়—সমাজের জন্যও ভয়ংকর বার্তা বহন করে। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।”
এই গ্রেফতারের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে বলছেন, আন্দোলনের আবেগকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা আন্দোলনের মূল চেতনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। আবার কেউ কেউ নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন।
Leave a comment