আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার শুনানিতে বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) শেখ হাসিনা ও সাবেক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসের মধ্যে হওয়া ফোনালাপ প্রকাশের মাধ্যমে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন কথোপকথনে, আন্দোলন দমনের নানা কৌশল ও নির্দেশ উঠে আসে।
ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন প্যানেল সেদিন মামলার ২২তম কার্যদিবসে সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। ৫৩তম সাক্ষী হিসেবে বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। সাক্ষ্য শেষে ট্রাইব্যুনালে চারটি ফোনালাপ শোনানো হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত ছিল শেখ হাসিনা ও ফজলে নূর তাপসের কথোপকথন।
ফোনালাপের বিষয়বস্তু- ফোনালাপে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও স্পষ্ট করে জানান, তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। আলোচনায় উঠে আসে গুলিবর্ষণের মতো ‘লেথাল ওয়েপন’ ব্যবহারের বিষয়টিও।
হাসিনা বলেন, “আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে, ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিছি, এখন লিথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সোজা গুলি করবে।” কথোপকথনে তিনি আরও উল্লেখ করেন, এতদিন ছাত্রদের কথা ভেবে সংযম দেখানো হয়েছিল, তবে রাতে যাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তাপসের সঙ্গে আলাপচারিতায় শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনী, র্যাব, এনএসআই ও ডিজিএফআইকে ধরপাকড়ের নির্দেশনার কথাও উল্লেখ করেন। রাতের আঁধারে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা হয়।
আন্দোলন দমন কৌশল- আলোচনায় গুলশান, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীদের উপস্থিতি ও সম্ভাব্য আক্রমণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তাপস। শেখ হাসিনা তাকে আশ্বস্ত করেন যে সেনাপ্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তিনি জানান, ড্রোন ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল।
উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ১০ জুলাই বিচার শুরু হয়। মামলায় সাবেক আইজিপি ইতোমধ্যে দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন এবং তার সাক্ষ্যও রেকর্ড করা হয়েছে।
সর্বশেষ শুনানিতে তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ফোনালাপগুলো দাখিল করেন। ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশনের আবেদনে এগুলো বাজিয়ে শোনানোর অনুমতি দেয়। প্রসিকিউশন জানায়, সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে যুক্তিতর্ক পর্ব শুরু হবে। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর)।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যান্যরা। তাদের দাবি, ফোনালাপে শেখ হাসিনার দেওয়া নির্দেশনা প্রমাণ করে আন্দোলন দমনে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ফোনালাপ প্রকাশ্যে আসার পর আদালতকক্ষ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু মামলার আইনি গুরুত্বই নয়, বরং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের কৌশল ও বাস্তবতার একটি প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শোনানো শেখ হাসিনা-তাপস ফোনালাপ নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থান দমনে গৃহীত পদক্ষেপ ও কঠোর নির্দেশনার প্রমাণ হিসেবে এটি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ মোড় আনতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন সাক্ষ্য ও যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে মামলার গতিপথ আরও স্পষ্ট হবে।
Leave a comment