ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগের দিন ৪ আগস্ট উত্তাল ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরের কাছে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের সময় মাথায় গুলিবৃদ্ধ হয়ে শহীদ হন মাসুদ রানা মুকুল (৩৫)।
মাসুদ রানা মুকুল চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের স্কুল পাড়ার আব্দুর রায়হান ও জাহানারা খাতুনের ছোট ছেলে। আব্দুর রায়হান ও জাহানারা দম্পতির তিন ছেলে ও দুই ময়ে। মুকুলের বড় ভাই বাবুল আক্তার গ্রামে কৃষি কাজের পাশাপাশি পানের ব্যবসা করেন। দুবাই প্রবাসী ছোট ভাই বকুল বিশ্বাস। বড় বোন মোমেনা খাতুন গৃহিণী। স্বামী ও সংসার নিয়ে মাখালডাঙ্গা গ্রামে শ্বশুরবাড়ি বসবাস করেন। ছোট বোন মাবিনা খাতুনও গৃহিণী। ভোগাইল বগাদী শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।
ঢাকার মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় সনি সিনেমা হলের পেছনের দিকে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন মাসুদ রানা মুকুল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নিরলসভাবে সহযোগিতা করেছেন মুকুল।
অন্য দিনের মত ৪ আগস্ট পানির বোতল ও বিস্কুট নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় অবস্থান করছিলেন। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে একটি গুলি মুকুলের মাথার পেছন দিক দিয়ে ঢুকে বাম কানের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে আন্দোলনকারী ছাত্ররা আলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে তাকে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিউট অব নিউরোসায়েন্সে ভর্তি করা হয়। রাত সোয়া একটার দিকে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে মুকুল না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
মাসুদ রানা মুকুলের জন্ম ১৯৯০ সালের ২৩ ডিসেম্বর। কয়রাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার হাতেখড়ি। প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে গোকুলখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ২০০৬ সালে সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন। পরে কুষ্টিয়া পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা পাস করেন।
২০১২ সালে চাকরির সন্ধানে মুকুল ঢাকায় যান। একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেছেন তিনি। সর্বশেষ স্মার্ট এ্যালিভেটর কোম্পানিতে চাকুরি করতেন। শহীদ হওয়ার ছয় মাস আগে দুই বন্ধু মিলে এমএস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন।
শহীদ মুকুলের স্ত্রীর নাম জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা। তাদের চার বছর বয়সী একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। তার নাম আরোবী বিনতে মাসুদ । স্বামী মুকুল মারা যাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে সাফা ঢাকা মিরপুর-১ এলাকায় বসবাস করছিলেন। তবে আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় গত মাসে ঢাকার বাসা ছেড়ে চুয়াডাঙ্গা ফিরে আসেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ৮-৯ মাস ধরে তিনি একটি অনলাইন ব্যবসা করেন। তবে ব্যবসা মন্দা যাওয়ায় সেটা আর ধরে রাখতে পারেনি।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে শহীদ মুকুলের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা (৩৫) বলেন, মুুকুল ৪ আগস্ট রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় বাড়ি থেকে বের হয়। এসময় আমি মুকুলকে বলি, ‘ঢাকার অবস্থা ভালো না, তুমি বাইরে যেও না। মুকুল বলে, ‘আমি আধাঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে চলে আসব।’ এটাই ছিল মুুকুলের সাথে আমার শেষ কথা।
পরে তার বন্ধু আলিমের মাধ্যমে জানতে পারি, সেদিন মুকুল অফিস থেকে ৮-১০টি পানির বোতল ও কিছু বিস্কুট নিয়ে বেলা ১২টার দিকে মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে আন্দোলনে যোগ দিতে যায়। ওখানে আন্দোলনকারী ছাত্রদের মাঝে পানি ও বিস্কুট বিতরণ করে। এর আগেও এভাবে ৫-৬ দিন শিক্ষার্থীদের পানি সরবরাহ করেছে সে।’
তিনি বলেন, ‘এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যাচ্ছে, মুকুলের সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারছি না। সন্ধ্যায় খবর আসল গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মুকুল । বড় ভাই মোজাম্মেলকে সাথে নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ। কেউ যেতে চায় না।’
বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ থাকায় অনেক ঘুরে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে পৌছলাম। গিয়ে দেখি ইমারজেন্সিতে রেখে দিয়েছে মুুকুলকে । তার আগে ওকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়েছিল। মাথায় গুলি পাওয়া যায়নি।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় রাত ৮টার দিকে আইসিইউতে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে আমার স্বামীকে দেখার জন্য আইসিইউতে নিয়ে যায় আমাকে। তখন সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছিল। বিকেলে গুলি লাগার পর মুকুল কোমায় চলে যায়। হাসপাতালের ডাক্তাররা রাত সোয়া ১টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ডাক্তারদের অনেক অনুরোধ করার পর হাসপাতাল থেকে একটি ডেত্থ সার্টিফিকেট দেয়। পরে ভোর রাত সাড়ে ৩ টার দিকে আমরা চুয়াডাঙ্গার উদ্দ্যেশে লাশ নিয়ে রওনা দিই। ৫ আগস্ট বাদ জোহর কয়রাডাঙ্গা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা সংলগ্ন কবরস্থানে মুকুলকে দাফন করা হয়।
সাফা বলেন, ‘মুকুল প্রতিদিন বাইরে গেলেও ফোনে মেয়ে আরোবী ও আমার খোঁজ নিতে। ওই দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফোন করেনি। আমিও শত চেষ্টা করে ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে ঘটনার দিন দুপুরে বড় ভাই বাবুল আক্তারের সাথে ফোনে কথা হয়। মুকুল তখন ভাইকে বলে, ‘দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। আপনি বাইরে যাইয়েন না।’
তখন বড় ভাই বাবুল, মুকুলকে বলে, ‘তুই কি বাইরে? তাহলে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যা।’ মুকুল বলে, ‘চলে যাবো ভাই। বন্ধু আলিমের কাছে মাথায় গুলি লাগার ৫ মিনিট আগে বলেছিল, আমি বাসায় চলে যাব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।
মুকুলের স্ত্রী সাফা জানান, তাদের পরিবারকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন নগদ সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা, আইডিবি থেকে ৫০ হাজার টাকা, বিএনপি ২০ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা করেছে।
সাফা বলেন, ‘কিছুদিন আগে ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে দর্শনায় বাবার বাড়িতে চলে এসেছি। আমার স্বামীর গ্রামে কোন বাড়ি-ঘর নেই। তাই আমার সন্তান নিয়ে থাকার ব্যবস্থা নাই। মুকুল মারা যাওয়ার পর বিভিন্নজনের কাছ থেকে যে অনুদান পেয়েছি, লোন পরিশোধ ও সংসারে খরচ করতে ফুরিয়ে গেছে সেটা। মুকুলের নামে এখনও ব্যাংকে লোন রয়েছে।’
মুকুলের কবরস্থান জঙ্গলে ভরে গেছে উল্লেখ করে সাফা বলেন, ‘স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য এখনও মুকুলের নামে কোথাও কোনো ফলক লাগানো হয়নি।’
মুকুলের মা জাহানারা খাতুন বলেন, ‘আমার ছোট ছেলে মুকুলের কথা আমি ভুলতে পারি না। সবসময় মনে হয় আমার ছেলে আসছে। আমাকে মা বলে ডাকছে। মারা যাবার দুই দিন আগে মুকুলের সাথে আমার শেষ কথা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার আহ্বায়ক আসলাম হোসেন অর্ক বলেন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সামাজিকভাবে মর্যাদা দিতে হবে মাসুদ রানাকে। নিশ্চিত করতে হবে অর্থনৈতিক সাপোর্ট। তার স্মৃতি রক্ষার্থে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে খুব শিগগির একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হবে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে কবরস্থান সংস্কার করার আহবান জানাচ্ছি। তিনি আরও জানান, সরকার থেকে এককালীন অর্থ সহায়তা পাবেন তার পরিবার।
সূত্র: বাসস
Leave a comment