বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ে এক বিস্ময়কর রাজনৈতিক ও আইনগত বাস্তবতা সামনে এসেছে। একাধিক সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন এমন প্রক্রিয়ায়, যেটিকে আদালত অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে—কিন্তু সেই রায় কার্যকর হতে হতে কেটে গেছে প্রায় পুরো মেয়াদ। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে, ভোটে নয়, বরং আদালতের মাধ্যমে ‘নির্বাচিত’ হচ্ছেন মেয়ররা। ফলে এই ‘আইনি বৈধতা’ আসলে কতটা গণতান্ত্রিক, তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসকে জয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। পরাজিত বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেন ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ, আদালত সেই ফলাফল বাতিল করে ইশরাককে বিজয়ী ঘোষণা করে। এরপর ইসি গেজেট প্রকাশ করলে ইশরাক আইনি প্রক্রিয়ায় মেয়র পদে আসীন হওয়ার সুযোগ পান। তবে এই নির্বাচনেই মাত্র ২৯ শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন বলে ইসির দাবি, যদিও সংশ্লিষ্টদের মতে প্রকৃত উপস্থিতি ছিল আরও কম।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী শাহাদাত হোসেন কারচুপির অভিযোগ এনে মামলা করেন। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও সরকারের পতনের পর আদালত তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করে। সরকারপক্ষের মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে পরে শাহাদাতকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও আদালতে মামলা চলছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম আদালতে তাঁর বিজয়ের দাবি জানানোর পাশাপাশি মাঠেও সক্রিয় আন্দোলনে রয়েছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসও একই দাবিতে মামলা করেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকার, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেছেন, আদালতের এসব রায় আসলে প্রমাণ করে যে নির্বাচনের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে এসব ‘কারচুপির’ নির্বাচনকে স্পষ্টভাবে অবৈধ ঘোষণা করা এবং এর মাধ্যমে কাউকে বৈধতা না দেওয়া।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, আদালতের রায়ে নির্বাচিত হওয়া ব্যক্তিরা যে সময় মেয়রের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন, সেটি কি প্রকৃত অর্থে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হবে? কিংবা এভাবে আদালতের মাধ্যমে মেয়র পদে বসলে সেই নির্বাচনকে কি পরোক্ষভাবে বৈধতা দেওয়া হয় না?
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনী মামলা নিষ্পত্তির জন্য আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের সীমা থাকলেও, বাস্তবে বছর পর বছর ধরে এসব মামলা ঝুলে থাকে। ফলাফলস্বরূপ, একদিকে প্রকৃত বিজয়ীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন, অন্যদিকে জনগণ একটি অবৈধ নেতৃত্বকে সহ্য করতে বাধ্য হন।
রাজনৈতিক দলগুলো এখন এক নতুন ধরণের সংকটে পড়েছে—যারা এতদিন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ‘অবৈধ’ বলে আসছিলেন, তারাই এখন সেই ব্যবস্থার ফলাফল গ্রহণ করে দায়িত্ব নেওয়ার দ্বিধায় ভুগছেন। ইশরাক হোসেন নিজেও বলেছেন, তিনি হারেননি, তাঁকে হারানো হয়েছিল। তবে তিনি মেয়রের দায়িত্ব নিলে, বিএনপির দীর্ঘদিনের নির্বাচনী অভিযোগ কি আপসে রূপ নেবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
এই পরিস্থিতি আমাদের সামনে এক কঠিন সত্য তুলে ধরে—নির্বাচন না হয়ে উঠলে জনগণের আস্থা অর্জন করা যাবে না। আর বিচারব্যবস্থা যদি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা গণতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিসাধন করতে পারে।
Leave a comment