ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় শ্রমজীবী নারী মর্জিনা বেগম হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা (পিবিআই)। তথ্যপ্রযুক্তি, সিসিটিভি ফুটেজ ও মোবাইল নম্বর বিশ্লেষণ করে মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে সংস্থাটি। পরিকল্পিতভাবে কৌশলে ডেকে নিয়ে তাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
নিহত মর্জিনা বেগম (৪৫) আখাউড়া পৌর এলাকার দেবগ্রাম এলাকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ইসমাইল মিয়ার স্ত্রী। জীবিকার তাগিদে তিনি সড়ক বাজার এলাকায় শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং সন্ধ্যার পর পিঠা বিক্রেতা হিসেবে কাজ করতেন। স্বামীকে নিয়ে নয়াবাজারে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন মর্জিনা। নিয়মিতই রাতবিরাতে কাজ শেষে বাড়ি ফিরতেন তিনি।
পিবিআই জানায়, ২৫ নভেম্বর ভোররাত আনুমানিক ৩টার সময় একটি অজ্ঞাত নম্বর থেকে মর্জিনার মোবাইলে ফোন কল আসে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে জানান, বাজারে ‘মালের গাড়ি এসেছে’, যা আনলোড করার জন্য তার সাহায্য প্রয়োজন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ফোন কলের মাত্র ১৪ মিনিট পর মর্জিনা বাসা থেকে বের হয়ে বাজার এলাকা পেরিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হন।
এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পরদিন সকাল থেকেই পরিবার তার খোঁজাখুঁজি শুরু করে। অবশেষে বিকেল ৫টার দিকে আখাউড়া পৌরসভা কার্যালয়ের পরিত্যক্ত টিনশেড ভবনের পাশে তার মরদেহ দেখতে পান স্থানীয়রা। গলায় আঘাতের চিহ্ন, শরীরে নির্যাতনের দাগ এবং পাশে পাওয়া যায় একজোড়া জুতা
গ্রেফতারকৃত মো. শহিদুল ইসলাম (৪৩) মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার কারিয়া গ্রামের বসিন্দা, হবিগঞ্জের জেলার রানীগঞ্জের শফিক (৪০) ও হবিগঞ্জ জেলার গয়েরপুরের মো. রুমান মিয়া (২৪)। তারা তিনজনই আখাউড়া পৌর এলাকার মসজিদপাড়ার লাল মিয়া হাজীর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।
শহিদুল ছিলেন সড়ক বাজারের দারোয়ান। তার পরিচয় ও কাজের কারণে সহজেই রাতে বাজার এলাকায় প্রবেশের সুযোগ ছিল।
তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, শহিদুল ইসলামই প্রথম মর্জিনাকে কৌশলে ফোন করে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। সেখানে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তিনজন মিলে তাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়।
তদন্তে উঠে এসেছে—প্রথমে শহিদুল ইসলাম তাকে ধর্ষণ করেন, এরপর দুই সহযোগী শফিক ও রুমানও ধর্ষণের চেষ্টা করলে মর্জিনা বাধা দেন, এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
একপর্যায়ে একজন তার গলা চেপে ধরে এবং অন্য দুইজন দুই হাত ও পা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করে। হত্যার পর দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে তারা। ঘটনার পর শহিদুল ইসলাম মোবাইল হারানোর নাটক সাজান। তবে পিবিআইয়ের প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিনি একই হ্যান্ডসেট ব্যবহার করছিলেন—শুধু সিমকার্ড পরিবর্তন করেছিলেন।
পিবিআই মঙ্গলবার রাতে সড়ক বাজার এলাকা থেকে শহিদুলকে গ্রেফতার করে। পরদিন বুধবার ভোরে তার দেওয়া তথ্যে মসজিদপাড়া এলাকা থেকে শফিক ও রুমান মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তিনজনই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপরাধ স্বীকার করেছে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিতে সম্মতি জানিয়েছে।
পিবিআই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পুলিশ সুপার শচীন চাকমা বলেন, “এটি একটি পরিকল্পিত ও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড। প্রযুক্তি বিশ্লেষণ এবং সিসিটিভি ফুটেজের ভিত্তিতেই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছে। যদি তদন্তে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।” নিহত মর্জিনার পরিবার বলছে, রাতবিরাতে তাকে ডেকে নেওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক ছিল। তারা দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
Leave a comment