একটি শিশু যদি বারবার চোখ টেপে, কাঁধ ঝাঁকায় বা অপ্রাসঙ্গিক শব্দ করে, তা দেখে অনেক অভিভাবক ভাবেন এটি বুঝি কোনো খারাপ অভ্যাস বা দুষ্টুমি। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, এগুলো হতে পারে একধরনের স্নায়ুবিক সমস্যা—যার নাম টিক ডিজঅর্ডার।
শিশুদের মধ্যে দেখা দেওয়া এই অবস্থাকে হালকাভাবে নেওয়া ঠিক নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে টিক বোঝায় এমন একটি শারীরিক আচরণ বা শব্দ যা আকস্মিক, অনিচ্ছাকৃত এবং পুনরাবৃত্ত। এটি দুইভাবে প্রকাশ পায়—মোটর টিক, যেমন চোখ টেপা, মাথা নাড়ানো বা মুখ বাঁকানো এবং ভোকাল টিক, যেমন গলা খাঁকারি, অদ্ভুত শব্দ বা কথা বলার মতো আচরণ।
অনেক সময় এগুলো কয়েক মাস পর আপনা-আপনিই সেরে যায়। কিন্তু যদি একটি নির্দিষ্ট টিক এক বছরের বেশি সময় ধরে থাকে, তখন সেটিকে বলা হয় ক্রনিক টিক ডিজঅর্ডার। আর মোটর এবং ভোকাল উভয় টিক একসঙ্গে এক বছরের বেশি সময় ধরে থাকলে তাকে বলা হয় টোরেট সিনড্রোম, যা তুলনামূলক জটিল একটি স্নায়ুবিক অবস্থা।
গবেষণায় টিক ডিজঅর্ডারের নির্দিষ্ট কারণ এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তবে চিকিৎসকরা মনে করেন, মস্তিষ্কের বাসাল গ্যাংলিয়া নামক অংশের কার্যকারিতার সমস্যা এর পেছনে দায়ী। বংশগত কারণ, মানসিক চাপ ও নিউরোকেমিক্যাল ভারসাম্যহীনতা এটিকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
এই অবস্থায় শিশুকে শাসন বা অপমান না করে বরং তার মনের ভেতরকার চাপ ও অস্বস্তি বোঝা জরুরি। অনেক শিশু নিজেই বুঝতে পারে তার আচরণ স্বাভাবিক নয়, তাই লজ্জা বা ভয় থেকে তা আড়াল করার চেষ্টা করে। এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবক ও শিক্ষকের সহানুভূতি এবং বোঝাপড়াই হতে পারে শিশুর প্রথম সান্ত্বনা।
পরীক্ষার সময়, মানসিক চাপে কিংবা নতুন পরিবেশে টিক বেড়ে যেতে পারে। তাই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেই অবস্থাগুলো চিহ্নিত করাও জরুরি। একইসঙ্গে স্কুলে শিক্ষকদের এই বিষয়ে সচেতন করতে হবে যেন তারা এমন শিশুর সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ করেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন যখন টিক শিশুর পড়াশোনা, সামাজিক সম্পর্ক বা আত্মবিশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে কিংবা ADHD, OCD বা উদ্বেগজনিত সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।
চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে CBIT (Cognitive Behavioral Intervention for Tics)—এক ধরনের মনোচিকিৎসা, যা টিক নিয়ন্ত্রণে অভ্যাস তৈরি করতে সাহায্য করে। গুরুতর ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগ করা হয় এবং মানসিক চাপ কমাতে রিল্যাক্সেশন থেরাপি ও মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন সহায়ক হতে পারে।
শিশুর আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখলে প্রথমেই সেটা বদভ্যাস হিসেবে না দেখে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া উচিত। কারণ, সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন স্বাভাবিক এবং আনন্দময় হতে পারে।
Leave a comment