সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। ছবিটিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা এবং দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমকে রাতের আঁধারে একসঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায়—এমন দাবিতে এটি ফেসবুক ও টিকটকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে ফ্যাক্টচেক অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আলোচিত এই ছবিটি বাস্তব নয়; বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা একটি ভুয়া ছবি।
তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের ফ্যাক্টচেক অনুসন্ধানে এসব দাবির কোনো বাস্তব ভিত্তি পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ছবিটির সত্যতা যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক কী–ওয়ার্ড ব্যবহার করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, নির্ভরযোগ্য সংবাদ সংস্থা এবং উন্মুক্ত তথ্যভাণ্ডারে খোঁজ নেওয়া হয়। কিন্তু কোথাও এই ছবির সত্যতা বা এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
এছাড়া এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ এবং সারজিস আলমের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করেও সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য, ছবি বা বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সাধারণত রাজনৈতিক বা জনপরিচিত ব্যক্তিদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটলে তা গণমাধ্যম বা তাদের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য উৎসের অস্তিত্ব নেই।
পরবর্তী ধাপে আলোচিত ছবিটি একাধিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শনাক্তকারী (AI detector) টুলের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। এসব টুলে যাচাই করে দেখা যায়, ছবিটির আলোকছায়া, মুখাবয়বের সূক্ষ্ম অসামঞ্জস্য, ব্যাকগ্রাউন্ডের অস্বাভাবিকতা এবং টেক্সচার—সব মিলিয়ে এটি এআই দিয়ে তৈরি হওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। একাধিক ডিটেক্টর একই ধরনের ফলাফল দেওয়ায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় যে ছবিটি বাস্তব কোনো ক্যামেরায় তোলা নয়।
ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলোচিত ছবিটি বাস্তব হিসেবে প্রচার করা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। এটি ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার করে তৈরি একটি কৃত্রিম কনটেন্ট, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ছবি ও ভিডিও—যাকে ‘ডিপফেক’ বা এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বলা হয়—দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট বা জনপরিচিত মানুষদের লক্ষ্য করে এমন ভুয়া কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে, যা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং জনমনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করতে পারে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা ও গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের ভুয়া ছবি ছড়ানোর পেছনে কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণ, আবার কখনো নিছক বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রবণতা কাজ করে। তবে উদ্দেশ্য যাই হোক, এর প্রভাব সমাজের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এআই দিয়ে তৈরি ভুয়া কনটেন্ট জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে, যা গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য উদ্বেগজনক।
রিউমর স্ক্যানার টিম তাদের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, এআই দিয়ে তৈরি একটি ছবিকে তাসনিম জারা ও সারজিস আলমের রাতের আঁধারে বসে থাকার বাস্তব ছবি হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে—যা সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনুরোধ জানিয়েছে, কোনো ছবি বা তথ্য শেয়ার করার আগে তা যাচাই করার জন্য।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, ডিজিটাল যুগে তথ্য যাচাই কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একটি আকর্ষণীয় ছবি বা শিরোনাম সহজেই মানুষের দৃষ্টি কাড়তে পারে, কিন্তু সেটির সত্যতা যাচাই না করলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অংশীদার হয়ে ওঠার ঝুঁকি থাকে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, সন্দেহজনক কোনো ছবি বা তথ্য দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম, ফ্যাক্টচেক সংস্থা কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অফিসিয়াল সূত্র থেকে যাচাই করা উচিত। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে—এআই দিয়ে তৈরি ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার।
সবশেষে বলা যায়, তাসনিম জারা ও সারজিস আলমকে ঘিরে ভাইরাল হওয়া রাতের আঁধারের ছবিটি বাস্তব নয়। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি একটি ভুয়া ছবি, যা যাচাই ছাড়াই প্রচার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। এই ধরনের ঘটনায় সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণই পারে ডিজিটাল ভ্রান্তির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।
Leave a comment