ইসলামি বিশ্বের জন্য এক শোকাবহ সংবাদ—সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত পবিত্র মসজিদে নববীর খ্যাতিমান মুয়াজ্জিন শেখ ফয়সাল নোমান ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার মৃত্যুতে মুসলিম বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মানুষ, আলেম-ওলামা এবং অসংখ্য মুসল্লির হৃদয়ে গভীর শোক নেমে এসেছে।
মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) ফজরের নামাজের পর মসজিদে নববীর প্রাঙ্গণে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় মসজিদে নববীর ইমাম, মদিনার বিশিষ্ট আলেম-ওলামা, সৌদি নাগরিক এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসল্লিরা অংশ নেন। জানাজা শেষে তাকে ইসলামি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবরস্থান—জান্নাতুল বাকি—তে দাফন করা হয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অসংখ্য সাহাবি ও আহলে বাইতের সদস্যদের কবরস্থান হওয়ায় জান্নাতুল বাকি মুসলমানদের কাছে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন।
শেখ ফয়সাল নোমান ২০০১ সালে (১৪২২ হিজরি) আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। প্রায় এক চতুর্থাংশ শতাব্দী ধরে তিনি নিষ্ঠা, বিনয় ও গভীর ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেছেন। তার কণ্ঠে উচ্চারিত আজান মসজিদে নববীর আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়ে ঈমানি আবেশ সৃষ্টি করত।
তিনি এমন একটি সম্মানিত ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান, যাদের বংশ পরম্পরায় মসজিদে নববীতে আজান দেওয়ার মহান দায়িত্ব পালিত হয়ে আসছে। তার দাদা মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন ছিলেন এবং তার বাবা অত্যন্ত অল্প বয়সেই—মাত্র ১৪ বছর বয়সে—এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়োগ পান। শেখ ফয়সাল নোমানের বাবা কয়েক দশক ধরে মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং নব্বই বছরেরও বেশি বয়স পর্যন্ত মুসল্লিদের নামাজের জন্য আহ্বান জানিয়ে গেছেন। এই ধারাবাহিকতা ইসলামের ইতিহাসে বিরল এক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত।
পারিবারিক এই ঐতিহ্যকে সম্মানের সঙ্গে ধারণ করে শেখ ফয়সাল নোমান নিজেকে আজান ও ইবাদতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রাখেন। সহকর্মী ও নিকটজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, অল্পভাষী এবং কর্তব্যপরায়ণ। আজান দেওয়াকে তিনি কেবল একটি দায়িত্ব নয়, বরং ইবাদত ও আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
মসজিদে নববীর নিয়মিত মুসল্লিরা জানান, তার আজানে ছিল এক ধরনের প্রশান্তি ও হৃদয়স্পর্শী আবেশ, যা মানুষকে নামাজের প্রতি আকৃষ্ট করত। বিশেষ করে ফজর ও মাগরিবের আজানে তার কণ্ঠ মুসল্লিদের মধ্যে গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতির সৃষ্টি করত। অনেক মুসলমান পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসেও টেলিভিশন বা অনলাইনের মাধ্যমে তার আজান শুনে আবেগাপ্লুত হয়েছেন।
তার ইন্তেকালের খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোকবার্তা ছড়িয়ে পড়ে। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের আলেম-ওলামা, ইসলামি চিন্তাবিদ ও সাধারণ মুসলমানরা তার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। অনেকেই লিখেছেন, শেখ ফয়সাল নোমানের আজান তাদের জীবনের স্মরণীয় অংশ হয়ে থাকবে।
ধর্মীয় বিশ্লেষকদের মতে, মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন হওয়া শুধু একটি সরকারি বা প্রশাসনিক পদ নয়; এটি ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক মহান দায়িত্ব। শেখ ফয়সাল নোমান সেই দায়িত্ব অত্যন্ত মর্যাদা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
তার মৃত্যু মসজিদে নববীর জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি হলেও, তিনি যে ঈমান, ঐতিহ্য ও নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শেখ ফয়সাল নোমানের ইন্তেকালে মুসলিম বিশ্ব একজন নিবেদিত খাদেম হারাল, যিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে পবিত্র মসজিদে নববীতে আজানের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর ঘরে আহ্বান জানিয়ে গেছেন। আল্লাহ তা’আলা তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন এবং তার পরিবারকে এই শোক সইবার তৌফিক দান করুন—এমনটাই কামনা করছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।
Leave a comment