প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে আবারও বিস্ময়ের মুখোমুখি বিশ্ব। তপ্ত মরুভূমির দেশ সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একাধিক এলাকায় দেখা গেছে বিরল তুষারপাত। যেখানে বছরের বেশির ভাগ সময় প্রচণ্ড তাপ, শুষ্ক বাতাস ও অনাবৃষ্টি নিত্যসঙ্গী, সেখানে হঠাৎ শুভ্র বরফে ঢেকে যাওয়া মরুভূমি নজিরবিহীন দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহে সৌদি আরবের তাবুক অঞ্চল ও ট্রোজেনা পার্বত্য এলাকার কিছু অংশে এই অস্বাভাবিক আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা গেছে। বিশেষ করে তাবুকের জাবাল আল-লাউজ এলাকায় বুধবার ভারী তুষারপাত হয়। রাস্তাঘাট, পাহাড়ি ঢাল ও বিস্তীর্ণ মরুভূমি পুরু বরফে ঢেকে যায়। বালির বদলে সাদা চাদরে মোড়া মরুপথে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায় উটসহ স্থানীয় পশুদের—যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এই দৃশ্যের ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে পড়তেই অনেকেই প্রথমে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি কি না—এ নিয়ে অনলাইনে শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক। তবে একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও সৌদি কর্তৃপক্ষের তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ঘটনাটি বাস্তব এবং স্বাভাবিক আবহাওয়ারই এক বিরল রূপ।
সৌদি আরব ও প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাত সাধারণত অত্যন্ত শুষ্ক জলবায়ুর জন্য পরিচিত। বছরে বৃষ্টিপাত হয় খুবই অল্প। ভারী বৃষ্টি তো দূরের কথা, অনেক এলাকায় বৃষ্টি দেখা যায় ‘ডুমুরের ফুল’-এর মতো। শীতকালে কোথাও কোথাও সামান্য বৃষ্টিপাত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এই প্রেক্ষাপটে মরুভূমির বুকে তুষারপাত স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি কৌতূহল ও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
আবহাওয়াবিদদের তথ্য অনুযায়ী, তাবুক অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান এই তুষারপাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৬০০ মিটার বা তারও বেশি উচ্চতায় অবস্থিত। ফলে সৌদি আরবের অন্যান্য অংশে যেখানে তীব্র তাপমাত্রা বিরাজ করে, সেখানে তাবুক অঞ্চলে শীতকালে তুলনামূলক ঠান্ডা আবহাওয়া দেখা যায়। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি নেমে আসাই এখানে তুষারপাতের সম্ভাবনা তৈরি করে।
এবারের তুষারপাতে তাবুক অঞ্চলে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের চার ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে নেমে গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় আবহাওয়া বিভাগ। ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে ঘরবাড়ি ও রাস্তায় তুষারের কণা ছড়িয়ে পড়ে । পার্ক করা গাড়িগুলোতে জমে যায় পুরু বরফের আস্তরণ, যা স্বাভাবিক জনজীবনকে সাময়িকভাবে ব্যাহত করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরবে তুষারপাতের পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক উপাদানের সম্মিলিত প্রভাব। উপরের বায়ুমণ্ডলে ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহ, আর্দ্রতার পরিমাণ বৃদ্ধি, বায়ুচাপের অস্বাভাবিক পরিবর্তন এবং ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রায় পর্যাপ্ত হ্রাস—এই চারটি শর্ত একসঙ্গে পূরণ হলেই মরু অঞ্চলে তুষারপাত সম্ভব হয়। এমন পরিস্থিতি অত্যন্ত বিরল হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা ক্রমেই চোখে পড়ছে।
এর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তাবুক অঞ্চলের কিছু অংশে তুষারপাত হয়েছিল। সে সময় কোথাও কোথাও প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বরফ জমে যায়, যা কয়েক দিন ধরে জনজীবন ব্যাহত করেছিল। আবার ২০২৪ সালের নভেম্বরে আল-নাফুদ মরুভূমিতে প্রথমবারের মতো তুষারপাত প্রত্যক্ষ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ওই অঞ্চলে আগে কখনো বরফ পড়েনি। তুষারপাতের আগে সেখানে ভারী বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি হয়েছিল, যা পরে বরফে রূপ নেয়।
সৌদির উত্তরের আল জাফ প্রদেশেও গত বছরের নভেম্বরে একই ধরনের দৃশ্য দেখা গেছে। যদিও শীতকালে এখানে তাপমাত্রা কমে যায়, আগে কখনো হিমাঙ্কের নিচে নামেনি। প্রবল শিলাবৃষ্টির পর হঠাৎ বরফে ঢেকে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা, যা স্থানীয়দের জন্য ছিল সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা।
এরও আগে, ২০১৬ সালে সৌদি আরবের কিছু অংশে তুষারপাত হয়েছিল। সে সময় তাবুক ও আল জাফ অঞ্চলের বাদামি বালিয়াড়ি সাদা আবরণে ঢেকে গিয়ে অনেকের চোখে ইউরোপীয় পাহাড়ি অঞ্চলের মতো মনে হয়েছিল।
সৌদি আরবের জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্র (এনসিএম) জানিয়েছে, কাসিম ও রিয়াদের উত্তরাঞ্চলেও অস্থির আবহাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পূর্বাভাসে বজ্রঝড়, ভারী বৃষ্টিপাত ও প্রবল বাতাসের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনসাধারণকে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, মরু অঞ্চলে তুষারপাত কোনোভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এ ধরনের পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। একই ধরনের অস্বাভাবিকতার নজির পাওয়া গেছে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিতেও। বিশ্বের বৃহত্তম উষ্ণ মরুভূমিতে গত ৪০ বছরে তিনবার তুষারপাতের ঘটনা ঘটেছে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন গবেষকরা।
সূত্র: গালফ নিউজ, খালিজ টাইমস, আরব নিউজ
Leave a comment