গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনের ভয়াবহ মানবিক পরিণতি প্রতিদিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষের মরদেহ উদ্ধার অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ মধ্য গাজা সিটির বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও ৯৪ জন ফিলিস্তিনির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতাকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
শনিবার এক বিবৃতিতে গাজার সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। সংস্থাটি জানায়, মধ্য গাজা সিটির একাধিক ধ্বংসপ্রাপ্ত আবাসিক এলাকা ও অবকাঠামোর নিচ থেকে এসব মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার কাজ পরিচালনায় সিভিল ডিফেন্সের পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা অংশ নেন।
সিভিল ডিফেন্সের বিবৃতিতে বলা হয়, উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলো ময়নাতদন্ত ও পরিচয় শনাক্তের প্রাথমিক প্রস্তুতির জন্য গাজা সিটির আল-শিফা মেডিকেল কমপ্লেক্সের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে মরদেহগুলো মধ্যাঞ্চলীয় শহর দেইর আল-বালাহর শহিদ কবরস্থানে দাফন করা হবে।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে উপত্যকার বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আবাসিক ভবন, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ধারণা, ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনের নিচে এখনো হাজার হাজার ফিলিস্তিনি চাপা পড়ে আছেন, যাদের অনেকেরই জীবিত থাকার সম্ভাবনা নেই।
গাজার সিভিল ডিফেন্স জানায়, উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে তারা চরম সংকটের মুখে পড়ছে। ভারী যন্ত্রপাতির অভাব, জ্বালানি সংকট, যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির কারণে উদ্ধার অভিযান ধীরগতিতে এগোচ্ছে। অনেক এলাকায় এখনো প্রবেশ করাই সম্ভব হয়নি।
সংস্থাটি আরও জানায়, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ধর্মীয় বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে সমাহিত হাজারো মরদেহ গাজার বিভিন্ন কবরস্থানে স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধের তীব্রতার সময় দ্রুত দাফনের প্রয়োজনীয়তায় অনেক মরদেহ অস্থায়ীভাবে সমাহিত করা হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ায় সেগুলো পুনরুদ্ধার করে ধর্মীয় নিয়ম মেনে দাফনের চেষ্টা চলছে।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি, যা এই সংঘাতের মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা আরও গভীর করে তুলেছে।
একই সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৭১ হাজার ১০০ জন। আহতদের একটি বড় অংশ স্থায়ী পঙ্গুত্বের ঝুঁকিতে রয়েছেন। যুদ্ধের কারণে হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো ধ্বংস বা অচল হয়ে পড়ায় পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং দক্ষ চিকিৎসক সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
গত ১০ অক্টোবর একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েলি এই আগ্রাসন আপাতত থেমে গেছে বলে জানানো হলেও বাস্তবে গাজার বাসিন্দারা এখনো নিরাপদ নন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় হামলা, গোলাবর্ষণ বা ড্রোন আক্রমণের শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। এতে যুদ্ধবিরতির কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলছে, গাজায় পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসাসেবার তীব্র সংকটে লাখো মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। শিশুদের অপুষ্টি ও সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে বলে আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে।
এদিকে, ধ্বংসস্তূপ থেকে একের পর এক মরদেহ উদ্ধারের খবরে গাজার বাসিন্দাদের মধ্যে শোক ও আতঙ্ক আরও গভীর হচ্ছে। বহু পরিবার এখনো তাদের স্বজনদের খোঁজে দিন কাটাচ্ছে, কেউ বেঁচে আছেন নাকি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন—এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধ বন্ধ হলেও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মরদেহ উদ্ধার, আহতদের চিকিৎসা এবং অবকাঠামো পুনর্গঠন করতে গাজাকে দীর্ঘ সময় ও আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হবে। ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এই মানবিক সংকট ভবিষ্যতেও নতুন করে সংঘাতের জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা।
সূত্র : টিআরটি ওয়ার্ল্ড
Leave a comment